গোপন নথি উদ্ধার ও তদন্তের সূত্রপাত
ভারতের বংশোদ্ভূত মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যাশলি টেলিসকে গ্রেপ্তার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল তদন্ত সংস্থা (এফবিআই)। অভিযোগ, তিনি শতাধিক গোপন নথি নিজের বাড়িতে রেখেছিলেন এবং চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করতেন। এই ঘটনায় ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
১৩ অক্টোবর ভার্জিনিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় জেলা আদালতে জমা দেওয়া এক হলফনামায় উল্লেখ করা হয়, টেলিসের বাড়ি থেকে ১,০০০ পৃষ্ঠারও বেশি শ্রেণিবদ্ধ নথি উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলোই “টপ সিক্রেট” ও “সিক্রেট” চিহ্নিত। বাড়ির বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি তিনটি আবর্জনার ব্যাগের ভেতর থেকেও এসব নথি পাওয়া যায়।
নিরাপত্তা লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ জানায়, টেলিস দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ সরকারি স্থাপনা থেকে গোপন নথি সরিয়ে নিজের বাড়িতে রেখে আসছিলেন, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। রাষ্ট্রদূত কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন যে, টেলিস শনিবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। আদালতের নথি অনুযায়ী, সেই দিনই তিনি পরিবারসহ রোমে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।
চীনের ওয়াশিংটন দূতাবাস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
প্রভাবশালী কূটনৈতিক ক্যারিয়ার
ভারতীয় বংশোদ্ভূত অ্যাশলি টেলিস যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাবশালী পররাষ্ট্রনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের সময়ে ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র–ভারত অসামরিক পারমাণবিক চুক্তির অন্যতম আলোচক ছিলেন তিনি। এর আগে ২০০১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ভারতের মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট ব্ল্যাকউইলের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
টেলিস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের কড়া সমালোচক হিসেবেও পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর বিজেপির তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান অমিত মালব্য মন্তব্য করেন, “এখন বোঝা যাচ্ছে কেন অ্যাশলি টেলিস, যাকে বিরোধী দলগুলো বারবার উদ্ধৃত করত, এত কঠোরভাবে আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন।”
চীনের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ
আদালতের নথি অনুযায়ী, টেলিস ২০০১ সাল থেকে উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা ছাড়পত্রধারী। তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র উপদেষ্টা এবং পেন্টাগনের ‘অফিস অব নেট অ্যাসেসমেন্ট’-এর ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতেন।
এফবিআইয়ের নজরদারি ফুটেজে দেখা যায়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে টেলিস সরকারি ভবন থেকে গোপন নথি প্রিন্ট ও সংগ্রহ করছেন। ১২ সেপ্টেম্বর তিনি পেন্টাগনের মার্ক সেন্টারে এক সহকর্মীকে “টপ সিক্রেট” চিহ্নিত একটি নথি প্রিন্ট করতে নির্দেশ দেন এবং পরে সেই কাগজগুলো নোটপ্যাডে লুকিয়ে নিজের ব্রিফকেসে রাখেন।
এছাড়া, ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের একটি গোপন সিস্টেমে প্রবেশ করে ১,২৮৮ পৃষ্ঠার একটি মার্কিন বিমানবাহিনীর ম্যানুয়াল খুলেছিলেন, যার নাম তিনি “ইকন রিফর্ম” নামে পরিবর্তন করেন, কয়েকশ পৃষ্ঠা প্রিন্ট করার পর ফাইলটি মুছে ফেলেন। আরও দুটি “সিক্রেট” নথিও তিনি প্রিন্ট করেন বলে অভিযোগ।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, টেলিস চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার ভার্জিনিয়ার ফেয়ারফ্যাক্স এলাকায় দেখা করেছেন। ২০২২ সালের এক নৈশভোজে তিনি একটি “ম্যানিলা খাম” নিয়ে পৌঁছান এবং খামটি ছাড়া অবস্থায় ফিরে যান। সর্বশেষ দেখা হয় ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫–এ, যখন তাঁকে একটি “লাল উপহারের ব্যাগ” দেওয়া হয়। যদিও গুপ্তচরবৃত্তির মামলা এখনো দায়ের করা হয়নি, এসব সাক্ষাৎ সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
নীতিনির্ধারক মহলে প্রতিক্রিয়া
ওয়াশিংটনের থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক অঙ্গনে এই খবর তীব্র আলোড়ন তুলেছে। স্টিমসন সেন্টারের ফেলো ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “২০০২ সালে টেলিসের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল। সব সময়ই তাঁকে ভদ্র ও চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে পেয়েছি। আইনি প্রক্রিয়ায় যেন ন্যায়বিচার ও সহানুভূতি বজায় থাকে, সেই আশা করছি।”
বিচার বিভাগের বিবৃতি
মঙ্গলবার মার্কিন বিচার বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, টেলিসের বিরুদ্ধে “জাতীয় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য বেআইনিভাবে সংরক্ষণের” অভিযোগ আনা হয়েছে।
ভার্জিনিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন মার্কিন অ্যাটর্নি লিন্ডসে হ্যালিগান বলেন, “আমরা দেশি-বিদেশি সব ধরনের হুমকি থেকে আমেরিকান জনগণকে সুরক্ষিত রাখার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই মামলায় উল্লিখিত অভিযোগগুলো আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করেছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “তথ্য ও আইন স্পষ্ট, এবং আমরা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আইনি প্রক্রিয়া কঠোরভাবে অনুসরণ করব।”
#যুক্তরাষ্ট্র, অ্যাশলি টেলিস, এফবিআই, গোপন নথি, চীন, গুপ্তচরবৃত্তি, মার্কিন বিচার বিভাগ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি