যুদ্ধবিরতির পরও ত্রাণে নতুন বাধা
ইসরায়েল ঘোষণা দিয়েছে, বুধবার থেকে গাজায় প্রবেশের অনুমতি পাওয়া সাহায্য ট্রাকের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনা হবে। জাতিসংঘ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।যুদ্ধবিরতির পর প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক ঢোকার প্রতিশ্রুতি থাকলেও এখন অনুমতি দেওয়া হবে মাত্র ৩০০ ট্রাককে। ফলে দুর্ভিক্ষকবলিত গাজায় খাদ্য ও জরুরি সরবরাহ দ্রুত পৌঁছানোর আশা আবারও পিছিয়ে গেল।
ইসরায়েলের সামরিক সংস্থা কোগাট (COGAT), যা গাজায় সাহায্য সরবরাহ তত্ত্বাবধান করে, জাতিসংঘকে জানিয়েছে—জ্বালানি ও গ্যাসও কেবল মানবিক অবকাঠামোগত প্রয়োজনে সীমিত পরিমাণে প্রবেশ করতে পারবে।
হামাসকে দায়ী করছে ইসরায়েল
কোগাটের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “হামাস গাজায় নিহত ইসরায়েলি জিম্মিদের মরদেহ ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। সেই কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মানবিক চুক্তির অংশ হিসেবে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
এ পর্যন্ত হামাস চারটি কফিন হস্তান্তর করেছে, কিন্তু অন্তত ২৩ জনের মরদেহ এখনো গাজায় রয়েছে এবং একজনের খোঁজ মেলেনি। সংস্থাটি মধ্যস্থতাকারীদের জানিয়েছে, তারা মঙ্গলবার আরও চারটি মরদেহ ইসরায়েলে হস্তান্তর করবে।
জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয় কার্যালয়ের মুখপাত্র ওলগা চেরেভকো বলেন, “আমরা আশা করছি মরদেহগুলো দ্রুত ফেরত দেওয়া হবে এবং যুদ্ধবিরতির শর্তগুলো কার্যকর থাকবে।”
৬০০ ট্রাকের প্রতিশ্রুতি থেকে ৩০০-তে নেমে এল
কোগাট গত সপ্তাহে জানিয়েছিল, যুদ্ধবিরতির সময় প্রতিদিন প্রায় ৬০০ ট্রাক গাজায় ঢুকবে। রোববার ৮১৭টি ট্রাক প্রবেশ করলেও সোমবারের সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি। জাতিসংঘের উপ-প্রবক্তা ফারহান হক বলেন, “আজ, সীমান্ত পার হয়ে কোনো নতুন ট্রাক ঢোকেনি; আমরা গাজার ভেতরে থাকা সরবরাহ থেকেই সাহায্য সংগ্রহ করছি।”
ইসরায়েলের নিয়ম অনুযায়ী, ট্রাকগুলো সীমান্তের ফিলিস্তিনি অংশে নামিয়ে দিতে হয়, সেখান থেকে জাতিসংঘ ও স্থানীয় সাহায্য সংস্থাগুলো পণ্য সংগ্রহ করে।
রাফাহ সীমান্ত বন্ধ, সাহায্য সংস্থার ক্ষোভ
তিনজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দক্ষিণের রাফাহ সীমান্ত(মিসরের সঙ্গে সংযোগ) খোলার পরিকল্পনাও স্থগিত করা হয়েছে।
ইউনিসেফের মুখপাত্র রিকার্ডো পিরেস বলেন, “সব সীমান্ত খুলতে হবে। রাফাহ বন্ধ থাকলে দক্ষিণ গাজায় বাস্তুচ্যুত মানুষদের কষ্ট আরও বাড়বে।”
যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণার পরও ত্রাণ বিলম্ব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার ঘোষণা দেন যে ইসরায়েল–হামাস সংঘাতের অবসান ঘটেছে এবং শেষ জীবিত জিম্মিদের বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর পরই ধারণা করা হচ্ছিল, ত্রাণ দ্রুত গাজায় পৌঁছাবে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মাত্র কয়েকটি ট্রাক প্রবেশ করছে। রেড ক্রসের মুখপাত্র ক্রিশ্চিয়ান কার্ডন বলেন, “অল্পসংখ্যক ট্রাক আসছে এবং অসংখ্য ক্ষুধার্ত মানুষ ওই ট্রাকগুলোর দিকে ভিড় করছে—যা কোনোভাবেই মানবিক মানদণ্ডে খাপ খায় না।”
জাতিসংঘের সীমিত অগ্রগতি
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) জানিয়েছে, সপ্তাহান্তে তারা মাত্র ১৩৭টি ট্রাক আনতে পেরেছে। গাজা শহরের প্রায় চার লাখ মানুষ কয়েক সপ্তাহ ধরে কোনো সাহায্য পাননি।
ইউনিসেফের মুখপাত্র টেস ইনগ্রাম জানান, তারা কিছু ট্রাকের মাধ্যমে জীবনরক্ষাকারী সামগ্রী—পরিবারের তাঁবু, প্লাস্টিকের চাদর, শীতবস্ত্র ও পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী—পাঠাতে পেরেছেন।
জাতিসংঘ বলছে, যেসব এলাকা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সরে গেছে, সেখানকার পথে চলাচল কিছুটা সহজ হয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক বাধা রয়ে গেছে।
চলমান প্রশাসনিক জটিলতা
প্রায় ৫০টি আন্তর্জাতিক সংস্থা—যেমন নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল, কেয়ার, অক্সফাম—তাদের পাঠানো সরবরাহের অনুমোদন পাওয়া যায়নি।
অক্সফামের নীতিবিষয়ক উপদেষ্টা বুশরা খালিদি বলেন, “আমরা একপ্রকার অচলাবস্থায় আছি। মাসের পর মাস দুর্ভিক্ষের মুখে থাকা জনসংখ্যার চাহিদা কেবল কয়েকটি ট্রাক দিয়ে মেটানো সম্ভব নয়।”
তবে ক্যাথলিক রিলিফ সার্ভিসেস সীমিতভাবে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের সামগ্রী আনতে অনুমতি পেয়েছে বলে সংস্থাটির কর্মকর্তা জেসন ন্যাপ্প জানিয়েছেন।
মার্কিন সহায়তাপুষ্ট সংস্থা কার্যক্রম স্থগিত
মার্কিন তহবিলপুষ্ট গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF) জানিয়েছে, তারা সাময়িকভাবে ত্রাণ বিতরণ স্থগিত করছে। গত শুক্রবার ছিল তাদের শেষ বিতরণ কার্যক্রম এবং চারটি বিতরণ কেন্দ্রের একটি বন্ধ করা হয়েছে।
সংস্থাটি জানায়, নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম চালানোর অর্থ রয়েছে, তবে কিছু “কৌশলগত পরিবর্তন” আনা হবে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল জাতিসংঘ যেন এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কাজ করে, কিন্তু জাতিসংঘ তা প্রত্যাখ্যান করে। জাতিসংঘের মতে, ওই ফাউন্ডেশনের বিতরণ পদ্ধতি নিরপেক্ষ নয় এবং তা সাহায্যকে সামরিকীকরণের দিকে ঠেলে দেয়।
সহায়তা চাওয়ার পথে প্রাণহানির আশঙ্কা
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর জানিয়েছে, জুলাই পর্যন্ত সাহায্যের জন্য ভিড় করা ৬০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে—বেশিরভাগই গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF) কেন্দ্র বা জাতিসংঘের ত্রাণ কাফেলার আশপাশে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জাতিসংঘের তথ্য বলছে, গাজার ভেতরে ক্ষুধার্ত মানুষ ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ত্রাণবাহী ট্রাক লুট করছে।
ইসরায়েলের নতুন সিদ্ধান্তে গাজার ত্রাণ কার্যক্রম আবারও বড় ধাক্কা খেল। জাতিসংঘ ও মানবিক সংস্থাগুলো বলছে, সীমান্ত খুলে না দিলে গাজার জনগণের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হবে এবং দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা আরও তীব্র হবে।
#গাজা #ইসরায়েল #হামাস #ত্রাণসংকট #জাতিসংঘ #মানবিকসহায়তা #রাফাহসীমান্ত #সারাক্ষণরিপোর্ট