চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পুনরায় জ্বলে ওঠা বাণিজ্যযুদ্ধের আগুন এখন নতুন মাত্রা নিচ্ছে। বেইজিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্মেলনের আগমুহূর্তে এই সংঘাত দেশটির নীতিনির্ধারকদের আরও ঐক্যবদ্ধ, আত্মনির্ভর ও প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক পথরেখায় এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করছে।
রাজনৈতিক সম্মেলনের আগেই উত্তেজনা বাড়ল
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের আগুন আবারও জ্বলে উঠেছে, বেইজিংয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্মেলন শুরুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে। চীনা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংঘাত দেশটিকে ঐক্যবদ্ধ হতে উৎসাহিত করতে পারে, বিশেষ করে যখন নীতিনির্ধারকেরা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
শাংহাই একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের জ্যেষ্ঠ গবেষক ইয়াং জিয়ানওয়েন বলেন, “চাপ, তা অভ্যন্তরীণ হোক বা বাহ্যিক, একতা তৈরি করতে পারে। এটাই আমাদের জাতীয় চরিত্র: বাইরের চাপকে আমরা প্রেরণায় রূপ দিতে পারি।”
নিষেধাজ্ঞা, শুল্ক ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া
গত সপ্তাহে বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ এবং শতভাগেরও বেশি শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছে। দীর্ঘ আলোচনার পরও এবং একাধিকবার যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানো সত্ত্বেও, সম্পর্কের সংকট কাটেনি।
নতুন সংঘাতের ক্ষেত্র হলো জাহাজ পরিবহন খাত। মঙ্গলবার থেকে দুই দেশ পরস্পরের জাহাজে বন্দর ফি আরোপ করেছে। একই দিনে বেইজিং দক্ষিণ কোরিয়ার শিপিং কোম্পানি হানওয়া ওশান-এর পাঁচটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়। চীনের অভিযোগ, এসব প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে চীনের নৌপরিবহন ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে সীমিত করার চেষ্টা করছে।
বেইজিংয়ের প্রতিক্রিয়া: পাল্টা জবাব, নয় আগ্রাসন
ইউরেশিয়া গ্রুপের চীন পরিচালক ওয়াং ড্যান বলেন, “বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে এই উত্তেজনা যুক্তরাষ্ট্রই শুরু করেছে। চীনের প্রতিক্রিয়া ছিল পরিমিত ও প্রতিসাম্যপূর্ণ।”
তিনি আরও বলেন, “এই প্রেক্ষাপটে আসন্ন চতুর্থ প্লেনারি সম্মেলনে চীন দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল কৌশলের ওপর জোর দেবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না বা নিজেদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা পরিবর্তন করবে না।”
চীনের শাসক কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে ২০ থেকে ২৩ অক্টোবর।
নতুন পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় প্রযুক্তিই মূল অগ্রাধিকার
এই বৈঠকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ ৩০০-রও বেশি সদস্য পরবর্তী পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার খসড়া নিয়ে আলোচনা করবেন। এতে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাড়তে থাকা উত্তেজনা এই পরিকল্পনাকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে।
ইয়াং জিয়ানওয়েন বলেন, “আগামী দুই বছর হবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। চীন সেমিকন্ডাক্টর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তিগতভাবে জটিল খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনে মনোযোগ দেবে—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এখনও প্রাধান্য ধরে রেখেছে এবং রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এগিয়ে থাকার কৌশল নিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “চীন সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, যাতে বড় কোনো সংকট দেখা দিলেও দেশের মৌলিক কাঠামো প্রভাবিত না হয়।”
প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান স্টাডিজ সেন্টারের উপপরিচালক সং গুয়োইউ বলেন, “প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতা ও জাতীয় নিরাপত্তা চীনের দীর্ঘমেয়াদি নীতি হলেও, বাণিজ্যযুদ্ধের উত্থান-পতন মূলত স্বল্পমেয়াদি প্রভাব তৈরি করছে। স্থানীয় সরকারগুলোকে এখনো তাদের উন্নয়ন কাঠামো বদলাতে বাধ্য করছে না।”
তিনি যোগ করেন, “তবে অনেকেই মনে করেন প্রকৃত আত্মনির্ভরতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। তাই এখন আমরা বিষয়টি আরও গভীর ও বাস্তবভাবে উপলব্ধি করছি।”
স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতার পথে চীন
চীনা একাডেমি অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনের গবেষক ঝৌ মি বলেন, “চীনের জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি ও প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা এখন অগ্রাধিকার।”
তিনি আরও বলেন, “প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সবসময় চীনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল এবং ১৫তম পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার সময়েও এটি অটল থাকবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত বিকাশ একদিকে নতুন সুযোগ তৈরি করছে, অন্যদিকে নতুন ঝুঁকিও আনছে—তাই আমাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে ঝুঁকি কমাতে হবে।”
ঝৌ বলেন, “আমরা সবসময়ই প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বকে স্বাগত জানিয়েছি। যদি কোনো অংশীদারের সঙ্গে সহযোগিতা অসম্ভব হয়ে ওঠে, তবে আমরা অন্য অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করব।”
#চীন #যুক্তরাষ্ট্র #বাণিজ্যযুদ্ধ #প্রযুক্তি #জাতীয়নিরাপত্তা #শিজিনপিং #এআই #সেমিকন্ডাক্টর #চীনযুক্তরাষ্ট্রসম্পর্ক #অর্থনীতি