০৭:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
সেনদাইয়ে ভালুক গুলি: শহুরে বন্যপ্রাণী নীতির নতুন পরীক্ষায় জাপান এআই-চাহিদায় শক্তি শেয়ার চড়া—গ্রিড, জ্বালানি ও মূল্যায়নে ঝুঁকিও বাড়ছে গুগলের ‘এআই ওভারভিউ’ নিয়ে অবকাঠামো জোটের পাল্টা চাপ শীতের আগে সহায়তা খুঁজতে ট্রাম্পের দ্বারস্থ জেলেনস্কি প্রধান ব্যাংকগুলো কীভাবে তাদের জলবায়ু কৌশল পুনর্বিবেচনা করছে ইউক্রেনে ড্রোন যুদ্ধ: খেলা না, জীবন রক্ষা সিল্কি আর অ্যান্ড বি আইকন ডি’এঞ্জেলো: সঙ্গীতের জগতে রহস্যময় এক অধ্যায় চীনের রপ্তানি বিধিনিষেধ: সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ার আশঙ্কা সিপিএসের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ না অনুসরণের প্রশ্ন ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু, নতুন আক্রান্ত ৭৫৫ জন

ভারতের মানসিক স্বাস্থ্য সংকটে নতুন আলোচনার প্রয়োজন কুসংস্কার ও অব্যবস্থার চাপে চিকিৎসাবিহীন কোটি মানুষ

দীপিকা পাড়ুকোনকে দূত করা—এক ইতিবাচক পদক্ষেপ

ভারত সরকার যখন অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোনকে, দেশের প্রথম মানসিক স্বাস্থ্য দূত হিসেবে নিয়োগ দেয়, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। তিনি নিজেই নিজের বিষণ্নতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা প্রকাশ্যে বলেছেন, যা সামাজিক কুসংস্কার ভাঙতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই উদ্যোগের পেছনে রয়েছে আরও গভীর সংকট—ভারত এখন দ্রুত বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হচ্ছে।

দেশটির সবচেয়ে বড় ও তরুণ জনগোষ্ঠী এখন মানসিক চাপ, অনিশ্চয়তা ও সামাজিক তুলনার জালে বন্দি। তথাকথিত ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ এখন অনেকাংশে মানসিক চাপের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।


আইন থাকলেও বাস্তব চিত্র হতাশাজনক

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে লক্ষাধিক মানুষ অটিজম থেকে

শিরোনাম: ‘পাগল’ ট্যাগের ভয়,শুরু করে স্কিজোফ্রেনিয়া পর্যন্ত নানা মানসিক রোগে ভুগছে। ২০১৭ সালের মানসিক স্বাস্থ্য আইনসহ একাধিক প্রগতিশীল নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও বাস্তব পরিস্থিতি এখনো আশানুরূপ নয়।

একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জানালেন—সবচেয়ে বড় বাধা হলো কুসংস্কার ও সামাজিক কলঙ্ক। ভারতীয় সমাজে মানসিক অসুস্থতা মানেই “পাগল” তকমা, যা পরিবারকে ভয়ের মধ্যে রাখে এবং তারা চিকিৎসার পরিবর্তে সমস্যাকে গোপন করে রাখে।


অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সংকটের পরিসংখ্যান

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, মানসিক স্বাস্থ্যজনিত রোগের আর্থিক প্রভাব ২০১২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে এক ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে (National Mental Health Survey) দেখা গেছে, ভারতের ১১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বর্তমানে মানসিক রোগে ভুগছেন এবং সারাজীবনের ঝুঁকি প্রায় ১৫ শতাংশ।


কুসংস্কার ও বিশ্বাসের ফাঁদে চিকিৎসাহীনতা

ভারতের অনেক অঞ্চলে এখনো মানসিক রোগকে “অশুভ আত্মা”, “পূর্বজন্মের পাপ” বা “অলৌকিক কারণ”-এর ফল বলে ধরা হয়। ফলে, বহু মানুষ চিকিৎসকের বদলে চলে যান তান্ত্রিক বা ফকিরের কাছে।

বিশেষত গৃহিণী ও যত্নদাত্রী নারীদের মধ্যে বিষণ্নতা বেড়েছে, কিন্তু তা সরকারি পরিসংখ্যানে খুব একটা ধরা পড়ে না। নগরজীবনের চাপ, একাকিত্ব এবং সম্পর্কের অভাব তাদের মানসিকভাবে ভেঙে দিচ্ছে। অনেক নারী সাহায্য চাইতে ভয় পান—ভেবে যে সমাজ তাদের “সমস্যাগ্রস্ত” বা “অযোগ্য স্ত্রী” হিসেবে দেখবে। ফলস্বরূপ পরিবারগুলো তাদের নিয়ে চলে যায় প্রতারক তান্ত্রিকদের কাছে, যারা অর্থ ও মানসিক নির্যাতন দুটোই করে।


প্রতারক বাবাদের রাজত্ব

ভারতে তথাকথিত ‘বাবা’ বা ‘আধ্যাত্মিক গুরু’-দের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। এদের অনেকেই মানসিক রোগ ও আসক্তি সারানোর দাবি করে বিকল্প চিকিৎসা কেন্দ্র চালান। উদাহরণস্বরূপ, দোষী সাব্যস্ত গুরু রাম রহিম তার আশ্রমে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল চালাতেন, যেখানে মানুষ চিকিৎসার আশায় আসতেন। সেখানে পুরুষদের ‘ক্যাস্ট্রেশন’ করিয়ে মানসিক রোগ সারানোর কথা বলা হতো, আর নারীরা হতেন যৌন নির্যাতনের শিকার। তবুও এমন আশ্রম এখনো দেশে ছড়িয়ে রয়েছে।

এইসব প্রতারকরা সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেয়—‘স্কিজোফ্রেনিয়া, ডায়াবেটিস, এইডস, এমনকি ক্যানসারের চিকিৎসা’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। বাস্তবে তারা নিজেরাই চিকিৎসাহীন।


আত্মহত্যা বাড়ছে, প্রয়োজন জাতীয় আলাপ

ভারতে আত্মহত্যার হার ভয়াবহ হারে বাড়ছে। ২০২২ সালে প্রতি লাখে আত্মহত্যার হার দাঁড়ায় ১২.৪ — গত ৫৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মাত্র এক বছরে এটি বেড়েছে ৩.৩ শতাংশ। সম্প্রতি এক দলিত আইপিএস কর্মকর্তা জাতিগত নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন—যা প্রমাণ করে, শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও মানসিক চাপ কতটা গভীর।

এই পরিস্থিতি রোধে এখনই প্রয়োজন একটি শক্তিশালী জাতীয় আলোচনা—যেখানে মানসিক রোগকে “লজ্জা” নয়, বরং একটি চিকিৎসাযোগ্য সমস্যা হিসেবে দেখা হবে। দীপিকা পাড়ুকোনের মতো দূতরা হয়তো এ লড়াইয়ের নতুন দরজা খুলে দিতে পারেন।


 নীরবতা ভাঙার সময়

ভারতের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বহু দশক ধরে আড়ালে ছিল। এখন সময় এসেছে নীরবতা ভেঙে প্রকৃত সমাধানের পথে হাঁটার। আইন, সচেতনতা ও মানবিক সহানুভূতি—এই তিনের সংমিশ্রণই পারে কোটি মানুষের মনের অন্ধকারে আলো আনতে।


#: ভারত, মানসিক_স্বাস্থ্য, দীপিকা_পাড়ুকোন, বিষণ্নতা, আত্মহত্যা, সামাজিক_কুসংস্কার, নারী_স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য_নীতি, সারাক্ষণ_রিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

সেনদাইয়ে ভালুক গুলি: শহুরে বন্যপ্রাণী নীতির নতুন পরীক্ষায় জাপান

ভারতের মানসিক স্বাস্থ্য সংকটে নতুন আলোচনার প্রয়োজন কুসংস্কার ও অব্যবস্থার চাপে চিকিৎসাবিহীন কোটি মানুষ

০১:৪৭:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫

দীপিকা পাড়ুকোনকে দূত করা—এক ইতিবাচক পদক্ষেপ

ভারত সরকার যখন অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোনকে, দেশের প্রথম মানসিক স্বাস্থ্য দূত হিসেবে নিয়োগ দেয়, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। তিনি নিজেই নিজের বিষণ্নতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা প্রকাশ্যে বলেছেন, যা সামাজিক কুসংস্কার ভাঙতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই উদ্যোগের পেছনে রয়েছে আরও গভীর সংকট—ভারত এখন দ্রুত বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হচ্ছে।

দেশটির সবচেয়ে বড় ও তরুণ জনগোষ্ঠী এখন মানসিক চাপ, অনিশ্চয়তা ও সামাজিক তুলনার জালে বন্দি। তথাকথিত ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ এখন অনেকাংশে মানসিক চাপের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।


আইন থাকলেও বাস্তব চিত্র হতাশাজনক

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে লক্ষাধিক মানুষ অটিজম থেকে

শিরোনাম: ‘পাগল’ ট্যাগের ভয়,শুরু করে স্কিজোফ্রেনিয়া পর্যন্ত নানা মানসিক রোগে ভুগছে। ২০১৭ সালের মানসিক স্বাস্থ্য আইনসহ একাধিক প্রগতিশীল নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও বাস্তব পরিস্থিতি এখনো আশানুরূপ নয়।

একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জানালেন—সবচেয়ে বড় বাধা হলো কুসংস্কার ও সামাজিক কলঙ্ক। ভারতীয় সমাজে মানসিক অসুস্থতা মানেই “পাগল” তকমা, যা পরিবারকে ভয়ের মধ্যে রাখে এবং তারা চিকিৎসার পরিবর্তে সমস্যাকে গোপন করে রাখে।


অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সংকটের পরিসংখ্যান

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, মানসিক স্বাস্থ্যজনিত রোগের আর্থিক প্রভাব ২০১২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে এক ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে (National Mental Health Survey) দেখা গেছে, ভারতের ১১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক বর্তমানে মানসিক রোগে ভুগছেন এবং সারাজীবনের ঝুঁকি প্রায় ১৫ শতাংশ।


কুসংস্কার ও বিশ্বাসের ফাঁদে চিকিৎসাহীনতা

ভারতের অনেক অঞ্চলে এখনো মানসিক রোগকে “অশুভ আত্মা”, “পূর্বজন্মের পাপ” বা “অলৌকিক কারণ”-এর ফল বলে ধরা হয়। ফলে, বহু মানুষ চিকিৎসকের বদলে চলে যান তান্ত্রিক বা ফকিরের কাছে।

বিশেষত গৃহিণী ও যত্নদাত্রী নারীদের মধ্যে বিষণ্নতা বেড়েছে, কিন্তু তা সরকারি পরিসংখ্যানে খুব একটা ধরা পড়ে না। নগরজীবনের চাপ, একাকিত্ব এবং সম্পর্কের অভাব তাদের মানসিকভাবে ভেঙে দিচ্ছে। অনেক নারী সাহায্য চাইতে ভয় পান—ভেবে যে সমাজ তাদের “সমস্যাগ্রস্ত” বা “অযোগ্য স্ত্রী” হিসেবে দেখবে। ফলস্বরূপ পরিবারগুলো তাদের নিয়ে চলে যায় প্রতারক তান্ত্রিকদের কাছে, যারা অর্থ ও মানসিক নির্যাতন দুটোই করে।


প্রতারক বাবাদের রাজত্ব

ভারতে তথাকথিত ‘বাবা’ বা ‘আধ্যাত্মিক গুরু’-দের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। এদের অনেকেই মানসিক রোগ ও আসক্তি সারানোর দাবি করে বিকল্প চিকিৎসা কেন্দ্র চালান। উদাহরণস্বরূপ, দোষী সাব্যস্ত গুরু রাম রহিম তার আশ্রমে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল চালাতেন, যেখানে মানুষ চিকিৎসার আশায় আসতেন। সেখানে পুরুষদের ‘ক্যাস্ট্রেশন’ করিয়ে মানসিক রোগ সারানোর কথা বলা হতো, আর নারীরা হতেন যৌন নির্যাতনের শিকার। তবুও এমন আশ্রম এখনো দেশে ছড়িয়ে রয়েছে।

এইসব প্রতারকরা সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেয়—‘স্কিজোফ্রেনিয়া, ডায়াবেটিস, এইডস, এমনকি ক্যানসারের চিকিৎসা’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। বাস্তবে তারা নিজেরাই চিকিৎসাহীন।


আত্মহত্যা বাড়ছে, প্রয়োজন জাতীয় আলাপ

ভারতে আত্মহত্যার হার ভয়াবহ হারে বাড়ছে। ২০২২ সালে প্রতি লাখে আত্মহত্যার হার দাঁড়ায় ১২.৪ — গত ৫৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মাত্র এক বছরে এটি বেড়েছে ৩.৩ শতাংশ। সম্প্রতি এক দলিত আইপিএস কর্মকর্তা জাতিগত নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন—যা প্রমাণ করে, শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও মানসিক চাপ কতটা গভীর।

এই পরিস্থিতি রোধে এখনই প্রয়োজন একটি শক্তিশালী জাতীয় আলোচনা—যেখানে মানসিক রোগকে “লজ্জা” নয়, বরং একটি চিকিৎসাযোগ্য সমস্যা হিসেবে দেখা হবে। দীপিকা পাড়ুকোনের মতো দূতরা হয়তো এ লড়াইয়ের নতুন দরজা খুলে দিতে পারেন।


 নীরবতা ভাঙার সময়

ভারতের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বহু দশক ধরে আড়ালে ছিল। এখন সময় এসেছে নীরবতা ভেঙে প্রকৃত সমাধানের পথে হাঁটার। আইন, সচেতনতা ও মানবিক সহানুভূতি—এই তিনের সংমিশ্রণই পারে কোটি মানুষের মনের অন্ধকারে আলো আনতে।


#: ভারত, মানসিক_স্বাস্থ্য, দীপিকা_পাড়ুকোন, বিষণ্নতা, আত্মহত্যা, সামাজিক_কুসংস্কার, নারী_স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য_নীতি, সারাক্ষণ_রিপোর্ট