সীমান্তে উত্তেজনা ও পাল্টা হামলা
আফগান ভূখণ্ডে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিমান হামলা এবং তার পরপরই তালেবানের পাল্টা আক্রমণ দুই দেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ইসলামাবাদ আশঙ্কা করছে, কাবুলের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা এখন “উদ্বেগজনক মাত্রায়” পৌঁছেছে। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বলছেন, আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্ভাব্য যৌথ কৌশল পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
৯ অক্টোবর পাকিস্তান আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি তালেবান (টিটিপি) নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদ ও তার সহযোগীরা। দুই দিন পর আফগান বাহিনী পাকিস্তানের সীমান্ত পোস্টে রাতের আক্রমণ চালায়, যার জবাবে ইসলামাবাদও পাল্টা আঘাত হানে। যদিও পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে কিছু জানায়নি, তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে—“নিরাপত্তা বাহিনী সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসী হুমকি প্রতিরোধে নির্দিষ্ট অভিযানে নেমেছে।”
অন্যদিকে, তালেবান দাবি করেছে যে তারা ২৫টি পাকিস্তানি পোস্ট দখল করেছে এবং ৫৮ জন সেনাকে হত্যা করেছে। পাকিস্তান এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে জানায়, তাদের বাহিনী ২১টি আফগান পোস্ট দখল করে ২০০-রও বেশি আফগান সেনাকে হত্যা করেছে।
টিটিপি ও সীমান্ত সন্ত্রাসের দায়
একজন পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিক্কেই এশিয়াকে জানান, আফগানিস্তানের ভূখণ্ডে অবস্থানরত টিটিপি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কাবুল কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ইসলামাবাদ কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। শুধুমাত্র খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশেই ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সন্ত্রাসী হামলায় ৭০০ নিরাপত্তাকর্মী ও ৪০০ সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, “এই অভিযান নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে, উদ্দেশ্য ছিল কেবল টিটিপির হুমকি দূর করা, সংঘাত বাড়ানো নয়।”
সম্পর্কের টানাপোড়েন ও ভারতের ভূমিকা
চলতি বছর ইসলামাবাদ ও তালেবান সরকার সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিল। মে মাসে পাকিস্তান কাবুলে তাদের রাষ্ট্রদূতের পদোন্নতি ঘোষণা করে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, বিশেষত যখন ইসলামাবাদ কাবুলকে জানায়—তাদের টিটিপি ও পাকিস্তানের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে।
সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (CRSS) পরিচালক ইমতিয়াজ গুল বলেন, “আফগান তালেবান টিটিপির বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিচ্ছে না, এতে পাকিস্তানের ধৈর্য শেষ হয়ে এসেছে।”
বিশ্লেষক ফখর কাকাখেল বলেন, “আফগান তালেবান এখন প্রকাশ্যে পাকিস্তানি তালেবানকে সমর্থন দিচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আফগান সীমান্ত অঞ্চলে টিটিপি যোদ্ধাদের আশ্রয়, প্রশিক্ষণ শিবির, এমনকি বিয়ের ব্যবস্থা পর্যন্ত করছে তালেবান নেতৃত্ব।”
ভারতের সঙ্গে কাবুলের ঘনিষ্ঠতা ইসলামাবাদের আশঙ্কা
পাকিস্তানের বিমান হামলার সময়ই আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুতাকি ভারত সফরে ছিলেন। এসময় নয়াদিল্লি ঘোষণা করে, কাবুলে তাদের পূর্ণাঙ্গ দূতাবাস পুনরায় চালু করা হবে। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বলছেন, “ভারত সফরের সময় আফগান বাহিনীর সীমান্তে হামলা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। এই ঘনিষ্ঠতা আমাদের নিরাপত্তার জন্য অশনিসঙ্কেত।”
গুল বলেন, “কাবুলের ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার অধিকার আছে, যেমন পাকিস্তান চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাখে। তবে ইসলামাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সন্দেহ উস্কে দেয়।”
কাকাখেলের মতে, ইসলামাবাদে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, সাম্প্রতিক মে মাসের সংঘর্ষের পর ভারত আবারও পাকিস্তানে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে। “ফলে এটি পূর্ব ও পশ্চিম—দুই সীমান্তে পাকিস্তানকে একযোগে ব্যস্ত রাখার কৌশল হতে পারে,” বলেন তিনি।
চীনের উদ্বেগ ও আঞ্চলিক প্রভাব
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন—যে দেশ দুই পক্ষেরই ঘনিষ্ঠ মিত্র—এই সংঘর্ষে সন্তুষ্ট নয়। তাইওয়ানভিত্তিক বিশ্লেষক গুলাম আলি বলেন, “চীন আফগানিস্তানের ভেতরে কোনো সামরিক পদক্ষেপ সমর্থন করবে না। যদিও তারা টিটিপি ও অন্যান্য গোষ্ঠীর কার্যক্রম নিয়ে উদ্বিগ্ন, তবুও বেইজিংয়ের পররাষ্ট্রনীতি সামরিক হস্তক্ষেপকে সমর্থন করে না।”
তিনি আরও বলেন, “আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সংঘাত চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পসহ আঞ্চলিক স্বার্থকে বিপন্ন করতে পারে। বেইজিং দুই প্রতিবেশী মিত্রের মধ্যে উত্তেজনা চায় না।”
আফগানিস্তানে পাকিস্তানের বিমান হামলা শুধুমাত্র সীমান্ত সন্ত্রাস দমনের অভিযান নয়, বরং এটি ইসলামাবাদের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা উদ্বেগ ও কূটনৈতিক হতাশার প্রতিফলন। তালেবান সরকারের ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও টিটিপির প্রতি নীরব সমর্থন দুই দেশের মধ্যে নতুন এক সংঘাতের সূচনা করেছে, যার প্রভাব গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা কাঠামোতে পড়তে পারে।
# পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তালেবান, টিটিপি, ভারত, চীন, সীমান্তসংঘর্ষ, কূটনীতি, নিরাপত্তা, সারাক্ষণ_রিপোর্ট