০৮:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
চীনকে পেছনে ফেলে বিশ্বের তৃতীয় শক্তিশালী বিমানবাহিনী ভারতের: নিউজউইক ভারতের ত্রিপুরায় তিন বাংলাদেশীকে গরু চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা দক্ষিণ এশিয়ার প্রাণঘাতী শঙ্খিনী সাপ ( ব্যান্ডেড ক্রাইট): রঙিন সৌন্দর্যের আড়ালে লুকানো মারাত্মক বিষ সৃজনশীলতা ও সাহিত্যের উৎসব: ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণে লিট-কার্নিভাল ২০২৫ হাঙ্গেরির রাজনৈতিক সংকট, ভিক্টর অরবান ও প্রোপাগান্ডার চ্যালেঞ্জ  কুড়িগ্রামের নয়টি কলেজে এইচএসসি পরীক্ষায় কেউ পাস করেনি রাফাহ খুলতে ইসরায়েল–মিসরের সমন্বয়, অস্থির যুদ্ধবিরতির মাঝে সতর্ক অগ্রগতি ভারতের কুইক-কমার্সে জেপ্টোর ৪৫০ মিলিয়ন ডলার—গতি নয়, লাভজনক ‘ডেনসিটি’ই লক্ষ্য” কেয়া পায়েলের জীবন কাহিনী: শৈশব থেকে অভিনয়ের সাফল্যের পথে অবকাশ শেষে রবিবার খুলছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত- প্রথম কার্যদিবসে সৌজন্য সাক্ষাৎ

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -৪০)

পুঁঠিয়া বংশের রাজাগণ– বৎসরাচার্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র পীতাম্বর ১৩ সাংসারিক কার্যে নিতান্ত পট ছিলেন। তিনি দিল্লির সম্রাটের অনুগ্রহ লাভ করিয়া লস্করপুর রাজ্যের ভার গ্রহণ করিলেন। তাহার এবং সর্ব কনিষ্ঠ পুষ্করাক্ষের নিঃসন্তানে মৃত্যুর পর, তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা নীলাম্বর উভয়েই সমস্ত রাজ্যভার গ্রহণ করেন এবং লস্করপুর পরগণার কর বৃদ্ধি করিয়া, রাজ্যের অনেক উন্নতি সাধন করেন। নীলাম্বরের কনিষ্ঠ পুত্র আনন্দরাম তাহার পিতা জীবিত থাকিতেই দিল্লির সম্রাটের নিকট হইতে “রাজা” উপাধ প্রাপ্ত হন; কিন্তু নীলাম্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র রতিকান্ত সর্বসাধারণের কোন অপ্রিয় কার্য করায় পিতৃ রাজ্যের অধিকারী হন নাই এবং “ঠাকুর” নামে সর্বজন নিকট পরিচিত হইয়া উঠিলেন। রতিকান্ত হইতে পুঁঠিয়ার রাজারা “ঠাকুর” নামে পরিচিত হইতে লাগিলেন। ১৫ রতিকান্তের পুত্র রামচন্দ্র ১৪। রামচন্দ্র কর্তৃক “রাধাগোবিন্দের” সেবা স্থাপিত হয়। রাধাগোবিন্দের নিত্য পূজা ও ভোগের বন্দোবস্ত এখনও অতি সুন্দর। ১/ আতপ তণ্ডুল এবং তদুপযোগী নানাবিধ উপকরণ দ্বারা প্রতিদিন ভোগ হইয়া থাকে। রামচন্দ্রের তিন পুত্র-নরনারায়ণ, দর্পনারায়ণ এবং জয়নারায়ণকে জীবিত রাখিয়া পরলোক গমন করেন। নরনারায়ণ ঠাকুরের সময় নাটোর রাজবংশের স্থাপন কর্তা রঘুনন্দনের পিতা কামদেব লস্করপুরের অন্তর্গত সরুইহাটি গ্রামের তহশীলদারী কার্যে নিযুক্ত ছিলেন। রামচন্দ্রের তিন পুত্র হইতে পুঁঠিয়া রাজবংশের সকলেরই নামে “নারায়ণ” সংযুক্ত হয়। নবাব মুরশিদকুলি খাঁর সময় রামচন্দ্রের তিন পুত্র বর্তমান ছিলেন।

 

দর্পনারায়ণের সময় কামদেবের পুত্র রঘুনন্দনের সৌভাগ্য লক্ষ্মী সুপ্রসন্নী হইলেন। দর্পনারায়ণের নিত্য পূজার পুষ্প সংগ্রহ করিবার কার্যে রঘুনন্দন নিযুক্ত ছিলেন। এই সামান্য কার্য হইতে তিনি নবাব সরকারে পুঁঠিয়া রাজার পক্ষে উকিলের কার্যে নিযুক্ত হন। এইরূপ নবাব দরবারে উকিল বা মুকতিয়ার নিযুক্ত করিবার প্রথা জমিদারগণ মধ্যে প্রচলিত ছিল। ১৩ রঘুনন্দন নাটোর রাজ্য স্থাপন করেন। ইহার বিবরণ যথাস্থানে লিখিত হইবে।

 

লর্ড কর্ণওয়ালিসের সময় আনন্দনারায়ণ লস্করপুর পরগণার রাজা ছিলেন। আনন্দনারায়ণের সঙ্গে লস্করপুর পরগণার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৮৯৫৯২।০ টাকা জমায় সম্পন্ন হয়। আনন্দ নারায়ণের একজন উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্রনারায়ণ ইংরাজ গবর্ণমেন্ট হইতে “রাজা বাহাদুর” উপাধি প্রাপ্ত হন। এই রাজেন্দ্রনারায়ণ পুঁঠিয়ার চারি আনা অংশের রাজা ছিলেন। যাহাকে সাধারণত চারি আনা অংশ বলে তাহা প্রকৃত।১৩-ক্রান্তির অংশ। এই রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে, তেমুখের নিকট তাজপুর গ্রাম নিবাসী হরিনাথ সান্যালের কন্যা সুর্যমণি দেবীর বিবাহ হয়। বিবাহের অল্পকাল পরেই রাজা পরলোক গমন করিলে, তাহার বিধবা পত্নী সূর্যমণি পতির সম্পত্তির অধিকারিণী হইলেন। রাণী সূর্যমণি একজন বুদ্ধিমতী এবং জমিদারি কার্যে সুবিজ্ঞা বলিয়া পরিচিতা ছিলেন। তিনি মহিলা হইয়া যেরূপ সুচারুরূপে কাজ কার্য নির্বাহ করিয়াছে। সেরূপ রাজকার্য নির্বাহ করিতে পঠিয়া বংশের অনেক রাজাই সক্ষম হন নাই। পঠিয়াবংশের ভুবনেন্দ্রনারায়ণ একজন ক্ষমতাবান পুরুষ ছিলেন। লস্করপুর পরগণার অংশ ব্যতীত তিনি অনেক জমিদারি ক্রয় করেন। তদপর বাংলা ১২১৪ সালে ভুবনেন্দ্রনারায়ণের পুত্র জগন্নারায়ণ নিম্নলিখিত জমিদারি খরিদ করিয়া নিজ রাজ্য ভুক্ত করেন।-

 

(১) ময়মনসিংহ জেলায় পরগণা পুকরিয়া।

 

(২) রাজসাহী জেলায় পরগণা কালীগাঁও কালীসপা এবং কাজিহাট।

 

(৩) জেলা নদীয়ায় ভবানন্দ দিয়াড়।

 

এইরূপে আয় বৃদ্ধি করিয়া জগন্নারায়ণ বারাণসী ধামে দেবমন্দির আদি প্রতিষ্ঠিত করিলেন এবং একটি ঘাট ও অতিথিশালা নির্মাণ করিলেন। ফলগু নদীর তীরে আর একটি অতিথিশালা প্রস্তুত করিয়া দেন। বাংলা ১২১৬ সালে তিনিও “রাজা বাহাদুর” উপাধি প্রাপ্ত হন। বাংলা ১২২৩ সালে তিনি পরলোক গমন করেন। তাহার বিধবা পত্নী পুঠিয়ায় শিবস্থাপন করিয়া তদুপলক্ষে বহুতর পণ্ডিত ব্রাহ্মণগণকে নিষ্কর ভূমি দান করেন। এই হিন্দু মহিলা দীন দুঃখীতে শীতকালে শীতবস্ত্র দিতেন এবং বর্ষাকালে গো ও মনুষ্যকে যথোচিত আহার দিতেন। এই প্রশংসিতা হিন্দুরমণীর নাম রাণী ভুবনময়ী দেবী।

 

তদপরে পুঁঠিয়া বংশীয় জনৈক ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ ঠাকুর নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইনি অত্যন্ত বাবু ছিলেন এবং ইহার বিষয় বুদ্ধি নিতান্ত কম ছিল। নিজ মূর্খতা এবং কুসংসর্গ দোষে তাহার ধনক্ষয় হয়। নানা কারণে তাহার বিস্তর ঋণ হয়, সেই ঋণ পরিশোধ জন্য তাহার সমস্ত সম্পত্তি হস্তান্তরিত করিতে হয়। শেষকালে দীঘাপতিয়ার রাজা প্রসন্ননাথ রায় বাহাদুরের সাহায্যের উপর নির্ভর করিয়া তাহার এবং তাহার পত্নীর জীবন রক্ষা হয়।

 

পরেশনারায়ণ রায় রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের বংশ-সম্ভূত। ইনি যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়ের সম-সাময়িক রাজা। পরেশনারায়ণ অপ্রাপ্ত বয়সে কোর্ট অব ওয়ারড্ডসের অধীন থাকিয়া ইংরেজি শিক্ষা করেন। বিদ্যাশিক্ষা শেষ না হওয়ার পূর্বেই তাহাকে রাজ্যভার গ্রহণ করিতে হয়। তিনি রাজ্যভার গ্রহণ করিয়া দীর্ঘকাল জীবিত ছিলেন না। এই অল্পকাল মধ্যে নিজ পুঠিয়া, রামপুরবোয়ালিয়া এবং তাহার নিজ জমিদারি মধ্যে কাপাসিয়া, জামরা, বাণেশ্বর, আড়ানী প্রভৃতি স্থানে বিস্তর স্কুল স্থাপিত করিয়া প্রজাপুঞ্জের মধ্যে শিক্ষা-বিস্তার করেন। পুঠিয়ার উচ্চ শ্রেণি ইংরেজি স্কুল তাহারই নাম এখনও ঘোষণা করিতেছে। ইনি সদাচারী নিষ্ঠাবান রাজা ছিলেন।

 

যোগেন্দ্রনারায়ণ রায় রাজা জগন্নানারায়ণ রায়ের পৌত্র। বাংলা ১২৪৭ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে যোগেন্দ্রনারায়ণের জন্ম হয়। তিনি অল্প বয়সে পিতৃহীন হইলে, তাহার সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীন হয়। সম্পত্তি ওয়ার্ডসের অধীন হওয়ার পর তাহার বিদ্যাশিক্ষা জন্য জেলার কালেক্টর সাহেবের আদেশে তাহাকে রামপুরবোয়ালিয়ায় আনাইয়া রাজসাহী জেলা স্কুলের নিম্নশ্রেণিতে প্রবিষ্ট করান হইল। রাজসাহী জেলা স্কুলে দুই কি এক বৎসরের জন্য তিনি লেখকের সমপাঠী ছিলেন।১৭ তদপরে সুশিক্ষিত ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের অধীনে কলিকাতা “ওয়ার্ডস-ইনস্টিটিউসনে”১৮ বিদ্যাশিক্ষার জন্য তাহাকে প্রেরিত হইল। যদিচ তিনি বুদ্ধিমান ছিলেন, তথাপি বিষয় চিন্তায় ও নানা কারণে তিনি বিদ্যাশিক্ষায় বিশেষ উন্নতি লাভ করিতে পারেন নাই। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার পূর্বেই, তিনি বাংলা ১২৬৭ সালে (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে) স্বহস্তে সমস্ত জমিদারির শাসনের ভার গ্রহণ করেন। ১৯ বাংলা ১২৪৭ সাল হইতে ১২৬৬ সাল পর্যন্ত, যোগেন্দ্রনারায়ণের বাল্যক্রীড়া, বিদ্যাশিক্ষা ও উদ্বাহ কার্য সম্পন্ন হয়। পিতা শিশুসন্তান রাখিয়া পরলোক গমন করিলে, সেই শিশুর বিদ্যাশিক্ষার অনেক বিঘ্ন ঘটে। শিশুকালে পিতার মৃত্যু হওয়ায় যোগেন্দ্রনারায়ণ এক মাত্র পুত্র বলিয়া মাতার স্নেহের পুত্তলি হইলেন। পিতার পরলোক গমনের পরেই যদিচ সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীন হইয়াছিল, তথাপি প্রায় ১৪/১৫ বৎসর পর্যন্ত পুঠিয়া রাজধানীতে রাখিয়াই শিক্ষার বন্দোবস্ত করা হইয়াছিল। সুতরাং পাঠের উন্নতি অধিক না হওয়ায়, তাহার বিবাহের পর শিক্ষার জন্য রামপুরবোয়ালিয়াতে তাহাকে আনা হইল। বিদ্যাশিক্ষায় অধিক উন্নতি লাভ না করিলেও যোগেন্দ্রনারায়ণ মাতার নিকট হইতে নেপোলিয়নের ন্যায় দয়া, উদারতা, সাহস, তেজস্বীতা এবং রাজকার্য কৌশল অনেক পরিমাণে শিক্ষাপ্রাপ্ত হন। বাংলা ১২৬২ সালে যোগেন্দ্রনারায়ণ ১৫ বৎসর বয়ঃক্রমে পতিত হইলেন। ঐ সালের বৈশাখ মাসে পুঁঠিয়া নিবাসী হরিনাথ সান্যালের ২০ পৌত্রী এবং ভৈরবনাথ সান্যালের কন্যা শরৎসুন্দরীর সহিত যোগেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ হয়। সে সময় শরৎসুন্দরীর বয়ঃক্রম কেবল সাড়ে পাঁচ বৎসর মাত্র। এই উদ্বাহ কার্য নির্বাহ হইবার অল্পকাল পরেই, যোগেন্দ্রনারায়ণের মাতা দুর্গাসুন্দরী পরলোকগম করেন। তাহার মাতার মৃত্যুর পর, বালিকা শরৎসুন্দরী পতির গৃহে বাস করিতে থাকেন। রাজগৃহে অন্য কোন অভিভাবিকা না থাকায়, যোগেন্দ্রনারায়ণ, হরসুন্দরী নাম্নী তাহার বিধবা মাতুলানীকে আনিয়া শরৎসুন্দরীর নিকট অভিভাবিকা স্বরূপ রাখিয়াছিলেন। “ইনি ব্যতীত যোগেন্দ্রনারায়ণের মাতা সহোদরা ভগিনী, শিবসুন্দরী দেবীও অনেক সময় শরৎসুন্দরীর নিকট থাকেন। শরৎসুন্দরী, ইহাদের দুই জনকে মাতার ন্যায় ভক্তি করিতেন। “২১ এবং ইহাদের নিকট অনেক পরিমাণে দেবীর ন্যায় নিজ চরিত্র গঠন করেন। এই সময় বোর্ড অব রেভিনিউয়ের আদেশ মতো যোগেন্দ্রনারায়ণকে বোয়ালিয়া হইতে কলিকাতা “ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউসনে” থাকিয়া শিক্ষাপ্রাপ্তি জন্য প্রেরিত হইল। কলিকাতার শিক্ষার কাল অতীত হওয়ার পর ১২৬৭ সালে (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে) নিজ সম্পত্তি ভারগ্রহণ করিয়া সাধ্বী, সুশীলা ও পতিভক্তি পরায়ণ পত্নীর সহবাসে রাজকার্য নির্বাহ করিতে লাগিলেন। এই সুখ দীর্ঘকাল স্থায়ী রহিল না। যোগেন্দ্রনারায়ণের বিবাহের পূর্বেই তাহার যাবতীয় সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে হয়। সেই সময় তাহার যাবতীয় ভূসম্পত্তি ইজারা বিলি হইয়াছিল। রাজসাহী ও নদীয়া জেলার সম্পত্তি রবার্ট ওয়াটসন কোম্পানির সহিত এবং ময়মনসিংহের সম্পত্তি মিঃ কে বার্ডি সাহেবের সহিত ইজারা বন্দোবস্ত হইয়াছিল। কোর্ট অব ওয়ার্ডস হইতে নাবালকের স্টেট তত্ত্বাবধান জন্য মেনেজার নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তিনি নির্বিবাদে কেবল দুই ইজারদারদের নিকট হইতে কিস্তি মত রাজস্ব আদায় করিয়া গবর্ণমেন্টের রাজস্ব দিতেন এবং সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করিতেন। এই ইজারা বন্দোবস্তই যোগেন্দ্রনারায়ণের অকাল মৃত্যুর কারণ হইয়াছিল। ওয়াটসন কোম্পানি নীলকর। লস্করপুর পরগণার অন্তর্গত পদ্মা, বড়াল, মুযাখাঁ ও নারদ নদীর অনেক চরে নীল জন্মিতে পারে এবং রাজসাহী মুরশিদাবাদ ও নদিয়ার অনেক স্থানে ওয়াটসন কোম্পানির অনেক নীল কুঠী আছে। এই নীল কুঠীর উন্নতি জন্য ওয়াটসন কোম্পানির যোগেন্দ্রনারায়ণের রাজসাহী ও নদীয়ার সম্পত্তি ইজারা লওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য বলিয়া প্রতীয়মান হইয়াছিল। বাংলা ১২৫৯ সাল হইতে বাংলা ১২৬৫ সাল পর্যন্ত ওয়াটসন কোম্পানির সহিত যোগেন্দ্রনারায়ণের রাজসাহী ও নদীয়ার সম্পত্তি ইজারা ছিল। ইজারার কাল অতীত হইলেও, “নিজ-জোত ২২ নামে কতকগুলি ভূমি ওয়াটসন কোম্পানি আপন দখলে রাখিয়া ছিলেন। প্রজারা, নিজ নিজ জোতের ভূমিতে নীল বুনানী করার জন্য কোম্পানির নিকট অগ্রিম দাদন গ্রহণ করিয়া, এগ্রিমেন্ট বা চুক্তিনামা লিখিয়া দিত। এই এগ্রিমেন্ট “সাটা” নামে খ্যাত। এই “নিজজোত” ও “সাটা” প্রজাদের অত্যাচারের কারণ হইয়া উঠিল। এই সূত্রে প্রজাদের ও ওয়াটসন কোম্পানির বিবাদ আরম্ভ হইল। যোগেন্দ্রনারায়ণের রাজ্যভার গ্রহণ করিবার পূর্বেই “সাটা” দ্বারা প্রজারা প্রপীড়িত হইয়াছিল। তাহার রাজ্যভার গ্রহণের পরে প্রজারা রীতিমত বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। যোগেন্দ্রনারায়ণও নিজ প্রজাদের রক্ষা জন্য তাহাদের উচ্ছৃঙ্খলতায় যোগ দিলেন এবং প্রাণপণে সাহায্য করিতে লাগিলেন। সুতরাং নীলকরদের দখল জন্য তিনি প্রাণ, ধন, সম্পত্তি অর্পণ করিলেন, ২৩ সুতরাং এই প্রতিজ্ঞা পালন জন্য, আহার নিদ্রা একপ্রকার ত্যাগ করিলেন।২৪ দিবা রাত্রি মধ্যে ৩ কি ৪ ঘণ্টার অধিক নিদ্রা যাইতেন না। তিনি নিজ ক্ষমতাগুণে অনেক পরিমাণে নীলকরের হস্ত হইতে নিজ দুঃখী প্রজাদের উদ্ধার করেন: কিন্তু সম্পূর্ণরূপে তাহাদিগকে উদ্ধার করিতে সক্ষম হন নাই। কৌশল অবলম্বন করিয়া ধীরে ধীরে প্রজার দুঃখ নিবারণের চেষ্টা ও যত্ন করিলে তিনি কিছুদিন জীবিত থাকিতে পারিতেন এবং রাজ্য ভোগ করিতে পারিতেন। তাহার অকাল মৃত্যুতেই প্রজা সমূহের কষ্টের অবসান হইল না। তিনি জীবিত থাকিলে কি হইত বলা যায় না। এই কার্য সম্পন্ন করিবার জন্য দুশ্চিন্তা শরীরে প্রবেশ করিয়া, যোগেন্দ্রনারায়ণের শরীর পতন হইল। নানা রোগ তাহাকে আক্রমণ করিল। আবার সূরার আশ্রয়ে রোগগুলি বৃদ্ধি পাইতেছিল। অত্যন্ত কাতর হইলে, তাহাকে বোয়ালিয়ায় আনা হইল, কিন্তু শরৎসুন্দরী দেবী পুঠিয়া রাজধানীতেই থাকিলেন। জেলার সিবিল সার্জন যোগেন্দ্রনারায়ণকে চিকিৎসা করিতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু চিকিৎসায় কোন ফল না হইয়া ক্রমে জ্বর, প্লীহা, যকৃৎ, অরুচি ও অজীর্ণ প্রভৃতি রোগ এরূপভাবে আক্রমণ করিল যে তাহার আর প্রাণে বাঁচিবার আশা রহিল না। “তিনি সকল আশা, সকল ভরসা, সকল দুঃখ, সকল সন্তাপ লইয়া যৌবনের প্রথম উদ্যমে অতৃপ্ত জীবনে, ১২৬৯ বঙ্গাব্দের ২৯ বৈশাখ তারিখে একুশ বৎসর এগারো মাস বয়সে ইহধাম ত্যাগ করিলেন। সে সময়ে বোয়ালিয়ায় কর্মচারী ও সাধারণ ভৃত্য ব্যতীত তাহার মৃত্যুকালে আত্মীয় বলিতে আর কেহই ছিল না।”

জনপ্রিয় সংবাদ

চীনকে পেছনে ফেলে বিশ্বের তৃতীয় শক্তিশালী বিমানবাহিনী ভারতের: নিউজউইক

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -৪০)

০৪:৫৪:১৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫

পুঁঠিয়া বংশের রাজাগণ– বৎসরাচার্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র পীতাম্বর ১৩ সাংসারিক কার্যে নিতান্ত পট ছিলেন। তিনি দিল্লির সম্রাটের অনুগ্রহ লাভ করিয়া লস্করপুর রাজ্যের ভার গ্রহণ করিলেন। তাহার এবং সর্ব কনিষ্ঠ পুষ্করাক্ষের নিঃসন্তানে মৃত্যুর পর, তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা নীলাম্বর উভয়েই সমস্ত রাজ্যভার গ্রহণ করেন এবং লস্করপুর পরগণার কর বৃদ্ধি করিয়া, রাজ্যের অনেক উন্নতি সাধন করেন। নীলাম্বরের কনিষ্ঠ পুত্র আনন্দরাম তাহার পিতা জীবিত থাকিতেই দিল্লির সম্রাটের নিকট হইতে “রাজা” উপাধ প্রাপ্ত হন; কিন্তু নীলাম্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র রতিকান্ত সর্বসাধারণের কোন অপ্রিয় কার্য করায় পিতৃ রাজ্যের অধিকারী হন নাই এবং “ঠাকুর” নামে সর্বজন নিকট পরিচিত হইয়া উঠিলেন। রতিকান্ত হইতে পুঁঠিয়ার রাজারা “ঠাকুর” নামে পরিচিত হইতে লাগিলেন। ১৫ রতিকান্তের পুত্র রামচন্দ্র ১৪। রামচন্দ্র কর্তৃক “রাধাগোবিন্দের” সেবা স্থাপিত হয়। রাধাগোবিন্দের নিত্য পূজা ও ভোগের বন্দোবস্ত এখনও অতি সুন্দর। ১/ আতপ তণ্ডুল এবং তদুপযোগী নানাবিধ উপকরণ দ্বারা প্রতিদিন ভোগ হইয়া থাকে। রামচন্দ্রের তিন পুত্র-নরনারায়ণ, দর্পনারায়ণ এবং জয়নারায়ণকে জীবিত রাখিয়া পরলোক গমন করেন। নরনারায়ণ ঠাকুরের সময় নাটোর রাজবংশের স্থাপন কর্তা রঘুনন্দনের পিতা কামদেব লস্করপুরের অন্তর্গত সরুইহাটি গ্রামের তহশীলদারী কার্যে নিযুক্ত ছিলেন। রামচন্দ্রের তিন পুত্র হইতে পুঁঠিয়া রাজবংশের সকলেরই নামে “নারায়ণ” সংযুক্ত হয়। নবাব মুরশিদকুলি খাঁর সময় রামচন্দ্রের তিন পুত্র বর্তমান ছিলেন।

 

দর্পনারায়ণের সময় কামদেবের পুত্র রঘুনন্দনের সৌভাগ্য লক্ষ্মী সুপ্রসন্নী হইলেন। দর্পনারায়ণের নিত্য পূজার পুষ্প সংগ্রহ করিবার কার্যে রঘুনন্দন নিযুক্ত ছিলেন। এই সামান্য কার্য হইতে তিনি নবাব সরকারে পুঁঠিয়া রাজার পক্ষে উকিলের কার্যে নিযুক্ত হন। এইরূপ নবাব দরবারে উকিল বা মুকতিয়ার নিযুক্ত করিবার প্রথা জমিদারগণ মধ্যে প্রচলিত ছিল। ১৩ রঘুনন্দন নাটোর রাজ্য স্থাপন করেন। ইহার বিবরণ যথাস্থানে লিখিত হইবে।

 

লর্ড কর্ণওয়ালিসের সময় আনন্দনারায়ণ লস্করপুর পরগণার রাজা ছিলেন। আনন্দনারায়ণের সঙ্গে লস্করপুর পরগণার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৮৯৫৯২।০ টাকা জমায় সম্পন্ন হয়। আনন্দ নারায়ণের একজন উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্রনারায়ণ ইংরাজ গবর্ণমেন্ট হইতে “রাজা বাহাদুর” উপাধি প্রাপ্ত হন। এই রাজেন্দ্রনারায়ণ পুঁঠিয়ার চারি আনা অংশের রাজা ছিলেন। যাহাকে সাধারণত চারি আনা অংশ বলে তাহা প্রকৃত।১৩-ক্রান্তির অংশ। এই রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে, তেমুখের নিকট তাজপুর গ্রাম নিবাসী হরিনাথ সান্যালের কন্যা সুর্যমণি দেবীর বিবাহ হয়। বিবাহের অল্পকাল পরেই রাজা পরলোক গমন করিলে, তাহার বিধবা পত্নী সূর্যমণি পতির সম্পত্তির অধিকারিণী হইলেন। রাণী সূর্যমণি একজন বুদ্ধিমতী এবং জমিদারি কার্যে সুবিজ্ঞা বলিয়া পরিচিতা ছিলেন। তিনি মহিলা হইয়া যেরূপ সুচারুরূপে কাজ কার্য নির্বাহ করিয়াছে। সেরূপ রাজকার্য নির্বাহ করিতে পঠিয়া বংশের অনেক রাজাই সক্ষম হন নাই। পঠিয়াবংশের ভুবনেন্দ্রনারায়ণ একজন ক্ষমতাবান পুরুষ ছিলেন। লস্করপুর পরগণার অংশ ব্যতীত তিনি অনেক জমিদারি ক্রয় করেন। তদপর বাংলা ১২১৪ সালে ভুবনেন্দ্রনারায়ণের পুত্র জগন্নারায়ণ নিম্নলিখিত জমিদারি খরিদ করিয়া নিজ রাজ্য ভুক্ত করেন।-

 

(১) ময়মনসিংহ জেলায় পরগণা পুকরিয়া।

 

(২) রাজসাহী জেলায় পরগণা কালীগাঁও কালীসপা এবং কাজিহাট।

 

(৩) জেলা নদীয়ায় ভবানন্দ দিয়াড়।

 

এইরূপে আয় বৃদ্ধি করিয়া জগন্নারায়ণ বারাণসী ধামে দেবমন্দির আদি প্রতিষ্ঠিত করিলেন এবং একটি ঘাট ও অতিথিশালা নির্মাণ করিলেন। ফলগু নদীর তীরে আর একটি অতিথিশালা প্রস্তুত করিয়া দেন। বাংলা ১২১৬ সালে তিনিও “রাজা বাহাদুর” উপাধি প্রাপ্ত হন। বাংলা ১২২৩ সালে তিনি পরলোক গমন করেন। তাহার বিধবা পত্নী পুঠিয়ায় শিবস্থাপন করিয়া তদুপলক্ষে বহুতর পণ্ডিত ব্রাহ্মণগণকে নিষ্কর ভূমি দান করেন। এই হিন্দু মহিলা দীন দুঃখীতে শীতকালে শীতবস্ত্র দিতেন এবং বর্ষাকালে গো ও মনুষ্যকে যথোচিত আহার দিতেন। এই প্রশংসিতা হিন্দুরমণীর নাম রাণী ভুবনময়ী দেবী।

 

তদপরে পুঁঠিয়া বংশীয় জনৈক ভৈরবেন্দ্রনারায়ণ ঠাকুর নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ইনি অত্যন্ত বাবু ছিলেন এবং ইহার বিষয় বুদ্ধি নিতান্ত কম ছিল। নিজ মূর্খতা এবং কুসংসর্গ দোষে তাহার ধনক্ষয় হয়। নানা কারণে তাহার বিস্তর ঋণ হয়, সেই ঋণ পরিশোধ জন্য তাহার সমস্ত সম্পত্তি হস্তান্তরিত করিতে হয়। শেষকালে দীঘাপতিয়ার রাজা প্রসন্ননাথ রায় বাহাদুরের সাহায্যের উপর নির্ভর করিয়া তাহার এবং তাহার পত্নীর জীবন রক্ষা হয়।

 

পরেশনারায়ণ রায় রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের বংশ-সম্ভূত। ইনি যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়ের সম-সাময়িক রাজা। পরেশনারায়ণ অপ্রাপ্ত বয়সে কোর্ট অব ওয়ারড্ডসের অধীন থাকিয়া ইংরেজি শিক্ষা করেন। বিদ্যাশিক্ষা শেষ না হওয়ার পূর্বেই তাহাকে রাজ্যভার গ্রহণ করিতে হয়। তিনি রাজ্যভার গ্রহণ করিয়া দীর্ঘকাল জীবিত ছিলেন না। এই অল্পকাল মধ্যে নিজ পুঠিয়া, রামপুরবোয়ালিয়া এবং তাহার নিজ জমিদারি মধ্যে কাপাসিয়া, জামরা, বাণেশ্বর, আড়ানী প্রভৃতি স্থানে বিস্তর স্কুল স্থাপিত করিয়া প্রজাপুঞ্জের মধ্যে শিক্ষা-বিস্তার করেন। পুঠিয়ার উচ্চ শ্রেণি ইংরেজি স্কুল তাহারই নাম এখনও ঘোষণা করিতেছে। ইনি সদাচারী নিষ্ঠাবান রাজা ছিলেন।

 

যোগেন্দ্রনারায়ণ রায় রাজা জগন্নানারায়ণ রায়ের পৌত্র। বাংলা ১২৪৭ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে যোগেন্দ্রনারায়ণের জন্ম হয়। তিনি অল্প বয়সে পিতৃহীন হইলে, তাহার সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীন হয়। সম্পত্তি ওয়ার্ডসের অধীন হওয়ার পর তাহার বিদ্যাশিক্ষা জন্য জেলার কালেক্টর সাহেবের আদেশে তাহাকে রামপুরবোয়ালিয়ায় আনাইয়া রাজসাহী জেলা স্কুলের নিম্নশ্রেণিতে প্রবিষ্ট করান হইল। রাজসাহী জেলা স্কুলে দুই কি এক বৎসরের জন্য তিনি লেখকের সমপাঠী ছিলেন।১৭ তদপরে সুশিক্ষিত ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের অধীনে কলিকাতা “ওয়ার্ডস-ইনস্টিটিউসনে”১৮ বিদ্যাশিক্ষার জন্য তাহাকে প্রেরিত হইল। যদিচ তিনি বুদ্ধিমান ছিলেন, তথাপি বিষয় চিন্তায় ও নানা কারণে তিনি বিদ্যাশিক্ষায় বিশেষ উন্নতি লাভ করিতে পারেন নাই। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার পূর্বেই, তিনি বাংলা ১২৬৭ সালে (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে) স্বহস্তে সমস্ত জমিদারির শাসনের ভার গ্রহণ করেন। ১৯ বাংলা ১২৪৭ সাল হইতে ১২৬৬ সাল পর্যন্ত, যোগেন্দ্রনারায়ণের বাল্যক্রীড়া, বিদ্যাশিক্ষা ও উদ্বাহ কার্য সম্পন্ন হয়। পিতা শিশুসন্তান রাখিয়া পরলোক গমন করিলে, সেই শিশুর বিদ্যাশিক্ষার অনেক বিঘ্ন ঘটে। শিশুকালে পিতার মৃত্যু হওয়ায় যোগেন্দ্রনারায়ণ এক মাত্র পুত্র বলিয়া মাতার স্নেহের পুত্তলি হইলেন। পিতার পরলোক গমনের পরেই যদিচ সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীন হইয়াছিল, তথাপি প্রায় ১৪/১৫ বৎসর পর্যন্ত পুঠিয়া রাজধানীতে রাখিয়াই শিক্ষার বন্দোবস্ত করা হইয়াছিল। সুতরাং পাঠের উন্নতি অধিক না হওয়ায়, তাহার বিবাহের পর শিক্ষার জন্য রামপুরবোয়ালিয়াতে তাহাকে আনা হইল। বিদ্যাশিক্ষায় অধিক উন্নতি লাভ না করিলেও যোগেন্দ্রনারায়ণ মাতার নিকট হইতে নেপোলিয়নের ন্যায় দয়া, উদারতা, সাহস, তেজস্বীতা এবং রাজকার্য কৌশল অনেক পরিমাণে শিক্ষাপ্রাপ্ত হন। বাংলা ১২৬২ সালে যোগেন্দ্রনারায়ণ ১৫ বৎসর বয়ঃক্রমে পতিত হইলেন। ঐ সালের বৈশাখ মাসে পুঁঠিয়া নিবাসী হরিনাথ সান্যালের ২০ পৌত্রী এবং ভৈরবনাথ সান্যালের কন্যা শরৎসুন্দরীর সহিত যোগেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ হয়। সে সময় শরৎসুন্দরীর বয়ঃক্রম কেবল সাড়ে পাঁচ বৎসর মাত্র। এই উদ্বাহ কার্য নির্বাহ হইবার অল্পকাল পরেই, যোগেন্দ্রনারায়ণের মাতা দুর্গাসুন্দরী পরলোকগম করেন। তাহার মাতার মৃত্যুর পর, বালিকা শরৎসুন্দরী পতির গৃহে বাস করিতে থাকেন। রাজগৃহে অন্য কোন অভিভাবিকা না থাকায়, যোগেন্দ্রনারায়ণ, হরসুন্দরী নাম্নী তাহার বিধবা মাতুলানীকে আনিয়া শরৎসুন্দরীর নিকট অভিভাবিকা স্বরূপ রাখিয়াছিলেন। “ইনি ব্যতীত যোগেন্দ্রনারায়ণের মাতা সহোদরা ভগিনী, শিবসুন্দরী দেবীও অনেক সময় শরৎসুন্দরীর নিকট থাকেন। শরৎসুন্দরী, ইহাদের দুই জনকে মাতার ন্যায় ভক্তি করিতেন। “২১ এবং ইহাদের নিকট অনেক পরিমাণে দেবীর ন্যায় নিজ চরিত্র গঠন করেন। এই সময় বোর্ড অব রেভিনিউয়ের আদেশ মতো যোগেন্দ্রনারায়ণকে বোয়ালিয়া হইতে কলিকাতা “ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউসনে” থাকিয়া শিক্ষাপ্রাপ্তি জন্য প্রেরিত হইল। কলিকাতার শিক্ষার কাল অতীত হওয়ার পর ১২৬৭ সালে (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে) নিজ সম্পত্তি ভারগ্রহণ করিয়া সাধ্বী, সুশীলা ও পতিভক্তি পরায়ণ পত্নীর সহবাসে রাজকার্য নির্বাহ করিতে লাগিলেন। এই সুখ দীর্ঘকাল স্থায়ী রহিল না। যোগেন্দ্রনারায়ণের বিবাহের পূর্বেই তাহার যাবতীয় সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে হয়। সেই সময় তাহার যাবতীয় ভূসম্পত্তি ইজারা বিলি হইয়াছিল। রাজসাহী ও নদীয়া জেলার সম্পত্তি রবার্ট ওয়াটসন কোম্পানির সহিত এবং ময়মনসিংহের সম্পত্তি মিঃ কে বার্ডি সাহেবের সহিত ইজারা বন্দোবস্ত হইয়াছিল। কোর্ট অব ওয়ার্ডস হইতে নাবালকের স্টেট তত্ত্বাবধান জন্য মেনেজার নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তিনি নির্বিবাদে কেবল দুই ইজারদারদের নিকট হইতে কিস্তি মত রাজস্ব আদায় করিয়া গবর্ণমেন্টের রাজস্ব দিতেন এবং সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করিতেন। এই ইজারা বন্দোবস্তই যোগেন্দ্রনারায়ণের অকাল মৃত্যুর কারণ হইয়াছিল। ওয়াটসন কোম্পানি নীলকর। লস্করপুর পরগণার অন্তর্গত পদ্মা, বড়াল, মুযাখাঁ ও নারদ নদীর অনেক চরে নীল জন্মিতে পারে এবং রাজসাহী মুরশিদাবাদ ও নদিয়ার অনেক স্থানে ওয়াটসন কোম্পানির অনেক নীল কুঠী আছে। এই নীল কুঠীর উন্নতি জন্য ওয়াটসন কোম্পানির যোগেন্দ্রনারায়ণের রাজসাহী ও নদীয়ার সম্পত্তি ইজারা লওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য বলিয়া প্রতীয়মান হইয়াছিল। বাংলা ১২৫৯ সাল হইতে বাংলা ১২৬৫ সাল পর্যন্ত ওয়াটসন কোম্পানির সহিত যোগেন্দ্রনারায়ণের রাজসাহী ও নদীয়ার সম্পত্তি ইজারা ছিল। ইজারার কাল অতীত হইলেও, “নিজ-জোত ২২ নামে কতকগুলি ভূমি ওয়াটসন কোম্পানি আপন দখলে রাখিয়া ছিলেন। প্রজারা, নিজ নিজ জোতের ভূমিতে নীল বুনানী করার জন্য কোম্পানির নিকট অগ্রিম দাদন গ্রহণ করিয়া, এগ্রিমেন্ট বা চুক্তিনামা লিখিয়া দিত। এই এগ্রিমেন্ট “সাটা” নামে খ্যাত। এই “নিজজোত” ও “সাটা” প্রজাদের অত্যাচারের কারণ হইয়া উঠিল। এই সূত্রে প্রজাদের ও ওয়াটসন কোম্পানির বিবাদ আরম্ভ হইল। যোগেন্দ্রনারায়ণের রাজ্যভার গ্রহণ করিবার পূর্বেই “সাটা” দ্বারা প্রজারা প্রপীড়িত হইয়াছিল। তাহার রাজ্যভার গ্রহণের পরে প্রজারা রীতিমত বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। যোগেন্দ্রনারায়ণও নিজ প্রজাদের রক্ষা জন্য তাহাদের উচ্ছৃঙ্খলতায় যোগ দিলেন এবং প্রাণপণে সাহায্য করিতে লাগিলেন। সুতরাং নীলকরদের দখল জন্য তিনি প্রাণ, ধন, সম্পত্তি অর্পণ করিলেন, ২৩ সুতরাং এই প্রতিজ্ঞা পালন জন্য, আহার নিদ্রা একপ্রকার ত্যাগ করিলেন।২৪ দিবা রাত্রি মধ্যে ৩ কি ৪ ঘণ্টার অধিক নিদ্রা যাইতেন না। তিনি নিজ ক্ষমতাগুণে অনেক পরিমাণে নীলকরের হস্ত হইতে নিজ দুঃখী প্রজাদের উদ্ধার করেন: কিন্তু সম্পূর্ণরূপে তাহাদিগকে উদ্ধার করিতে সক্ষম হন নাই। কৌশল অবলম্বন করিয়া ধীরে ধীরে প্রজার দুঃখ নিবারণের চেষ্টা ও যত্ন করিলে তিনি কিছুদিন জীবিত থাকিতে পারিতেন এবং রাজ্য ভোগ করিতে পারিতেন। তাহার অকাল মৃত্যুতেই প্রজা সমূহের কষ্টের অবসান হইল না। তিনি জীবিত থাকিলে কি হইত বলা যায় না। এই কার্য সম্পন্ন করিবার জন্য দুশ্চিন্তা শরীরে প্রবেশ করিয়া, যোগেন্দ্রনারায়ণের শরীর পতন হইল। নানা রোগ তাহাকে আক্রমণ করিল। আবার সূরার আশ্রয়ে রোগগুলি বৃদ্ধি পাইতেছিল। অত্যন্ত কাতর হইলে, তাহাকে বোয়ালিয়ায় আনা হইল, কিন্তু শরৎসুন্দরী দেবী পুঠিয়া রাজধানীতেই থাকিলেন। জেলার সিবিল সার্জন যোগেন্দ্রনারায়ণকে চিকিৎসা করিতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু চিকিৎসায় কোন ফল না হইয়া ক্রমে জ্বর, প্লীহা, যকৃৎ, অরুচি ও অজীর্ণ প্রভৃতি রোগ এরূপভাবে আক্রমণ করিল যে তাহার আর প্রাণে বাঁচিবার আশা রহিল না। “তিনি সকল আশা, সকল ভরসা, সকল দুঃখ, সকল সন্তাপ লইয়া যৌবনের প্রথম উদ্যমে অতৃপ্ত জীবনে, ১২৬৯ বঙ্গাব্দের ২৯ বৈশাখ তারিখে একুশ বৎসর এগারো মাস বয়সে ইহধাম ত্যাগ করিলেন। সে সময়ে বোয়ালিয়ায় কর্মচারী ও সাধারণ ভৃত্য ব্যতীত তাহার মৃত্যুকালে আত্মীয় বলিতে আর কেহই ছিল না।”