ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জেরে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর ফলে একাধিক মৃত্যুও ঘটেছে গত কয়েকদিনে।
কয়েক দশক পরে ভয়াবহ প্লাবনের মুখে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। গত চার ও পাঁচ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতে অতিবৃষ্টি ও হড়পা বানে ভেসে যায় একের পর এক জনপদ।
ঘরছাড়া মানুষ ও প্রাণী
১৯৬৮ সালের পরে এটাই উত্তরবঙ্গে সবচেয়ে বড় মাপের প্লাবন। সেবারও প্রায় একই তারিখে বানভাসি হয়েছিল একাধিক জেলা। এই দুর্যোগে শুধু মানুষ নয়, বন্যপ্রাণীও তাদের ঘর হারিয়েছে। মানুষের মতো অনেক বন্য জীবজন্তুর মৃত্যু হয়েছে। যে এলাকায় প্লাবন হয়েছে, সেখানে রয়েছে জলদাপাড়া, গোরুমারার মতো জাতীয় অভয়ারণ্য। এই ভূখণ্ডের একটা বড় অংশ জঙ্গলে ঘেরা, সেখানে হঠাৎ প্লাবন আসায় ক্ষতি হয়েছে উভয়েরই।
দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পরেও মানুষের মতোই প্রাণীকুলের বাসস্থান বসবাসের যোগ্য হয়ে ওঠেনি। সেখানে বিঘের পর বিঘে জমিতে পলি পড়েছে, হারিয়ে গিয়েছে সবুজ। এর ফলে খাবারে টান পড়েছে। তাই পেট ভরাতে লোকালয়ের দিকে পা বাড়িয়েছে পশুর দল। এছাড়া প্লাবনভূমিতে পরিস্থিতি এমনই যে তা বন্যপ্রাণীর বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত নয়।
একাধিক মৃত্যু
বিপর্যয়ের দুই দিনের মাথায় কোচবিহারের মাথাভাঙায় বুনো শুয়োরের আক্রমণে মারা যান এক গ্রামবাসী। মাথাভাঙা-দুই ব্লকের ঘোকসাডাঙা থানার অধীন ভেলাকোপা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন কাশীকান্ত বর্মন। তিনি যখন মাঠে গরু চরাতে গিয়েছিলেন, তখন বুনো শুয়োর তাকে আক্রমণ করে। এই ঘোকসাডাঙারই ধীরেন বর্মন নামে আর এক গ্রামবাসী শুয়োরের আক্রমণে মারা যান। তিনি তোর্সা নদীর ধারে ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন। সেই সময় পশুর দল তাকে আক্রমণ করে।
জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ির মধ্যখট্টিমারি ও নাথুয়াতে জলে ভেসে এসেছিল একটি বুনো শুয়োর। সেটি গ্রামে ঢুকে এলোমেলো ঘুরতে থাকে। স্থানীয় নয়জন বাসিন্দা তার আক্রমণে আহত হয়েছেন।
হড়পা বানে অনেক বন্য জন্তু মানুষের মতোই ভেসে গিয়েছে। নদীর জল তাদের নিয়ে এসেছে লোকালয়ে। গন্ডারের মতো অতিকায় প্রাণীকেও ভাসিয়ে গ্রামের মধ্যে এনে ফেলেছে প্লাবন। এখান থেকে নদীপথে একটি গন্ডার ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশে। সেখানে তার মৃতদেহের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়।
মাথাভাঙা-২ ব্লকে তোর্সা নদীর জলে ভেসে আসে ছয়টি গন্ডার। এর মধ্যে পাঁচটিকে জঙ্গলে ফেরানো সম্ভব হলেও একটিকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। এই গন্ডারটি পুন্ডিবাড়ি এলাকায় ঢুকে পড়ে। এখানকার বাজার সংলগ্ন সুভাষপল্লীতে একটি জলাশয়ে ঘাপটি মেরেছিল সে। সকালে বাড়ি থেকে বেরোনো স্থানীয় বাসিন্দা দিলীপ দাস ও বিভা করকে আক্রমণ করে গন্ডারটি। গুরুতর আহত দিলীপকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও বাঁচানো যায়নি।
পরে বনবিভাগের তৎপরতায় ঘুম পাড়ানি গুলি ছুড়ে কাবু করা হয় গন্ডারকে। তাকে ছেড়ে দেয়া হয় চিলাপাতার জঙ্গলে। মাথাভাঙা-২ ব্লকের কলাবাগানে একটি গন্ডার কাদায় আটকে পড়ে। সে কিছুতেই কাদা ছেড়ে উঠতে পারছিল না। এই গন্ডারকে উদ্ধার করতে বেগ পেতে হয় বন দপ্তরকে।
উত্তরবঙ্গের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বন দপ্তর প্রতিটি বন বিভাগে একটি করে কুইক রেসপন্স টিম তৈরি করেছে। লোকালয়ে বন্যপ্রাণী ঢুকে পড়ার খবর পেলে দ্রুত সেখানে পৌঁছচ্ছে দলটি।
সাপের উপদ্রব
উত্তরবঙ্গের যেসব এলাকা বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে, তার বড় অংশ অরণ্য লাগোয়া। জনবসতির আশপাশের নদীর জলে এলাকা ভেসে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে সাপের মতো সরীসৃপের বাস্তুতন্ত্র। সাপ চলে আসছে কিছুটা শুকনো জায়গায় অর্থাৎ লোকালয়ে।
দুর্যোগের পরে বিভিন্ন গ্রামে বিষধর সাপের উপদ্রব দেখা যাচ্ছে। যেসব এলাকার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে, সেখানে আশ্রয় নিয়েছে সাপ। এর ফলে সাপে কাটার আশঙ্কা বাড়ছে। একাধিক পরিবেশপ্রেমী সংগঠন গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে সজাগ থাকতে বলছে। বন দপ্তর প্রতিটি হাসপাতালে অ্যান্টিভেনাম মজুত রাখার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তরকে।
জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের সম্পাদক নন্দু রায় ডিডাব্লিউকে বলেন, “আমরা মানুষের মধ্যে সচেতনতা দেখছি। এত দুর্যোগের মধ্যেও মানুষের বাড়িতে সাপ ঢুকলে তারা সাপ মারছেন না। মশারি, ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করতে সচেতন করা হচ্ছে। এতে সংঘাতটা অনেকটাই আটকানো যাচ্ছে। যে যে সাপ উদ্ধার হচ্ছে বাড়িতে, সেগুলোর মধ্যে কেউটে, গোখরো, ময়াল, র্যাট স্নেক, কালাচ উল্লেখযোগ্য। উত্তরবঙ্গের দুর্যোগে সাপে কাটার ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু মৃত্যু হয়নি।”
বন্যপ্রাণীর বিপন্নতা
প্লাবনের মুখে পড়ে দিশেহারা মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করেছে। বিপর্যয়ের পরেই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গিয়েছে খাবার, জল। বিভিন্ন জায়গায় সরকারি উদ্যোগে শুরু হয়েছে পুনর্গঠনের কাজ। রাস্তা ও সেতু মেরামত করা হচ্ছে। কিন্তু অরণ্যের প্রাণীর যে বিপন্নতা, তাকে চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যথেষ্ট কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বন দপ্তরের কাছে।
একদিকে নিজেদের বাসস্থান ভেসে যাওয়া, তার সঙ্গে খাদ্যের সংকট এবং সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা সামগ্রিকভাবে আতঙ্কিত করে তুলেছে বন্যপ্রাণীদের। তারা খাবারের খোঁজে লোকালয়ে চলে আসার পরে মানুষকে শত্রু হিসেবে মনে করছে। সে কারণে মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর সংঘাতের ঘটনা বাড়ছে।
উত্তরবঙ্গে সাধারণ অবস্থায় এ ধরনের সংঘাতের খবর মাঝেমধ্যেই পাওয়া যায়। বিশেষত মানুষের সঙ্গে হাতির সংঘাত। হাতির চলাচলের যে করিডর রয়েছে, তার আশপাশেই মানুষের বাস। বিভিন্ন সময়ে হাতি লোকালয়ে ঢুকে খাবার নষ্ট করে, বাড়িঘর ভেঙে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মৃত্যু হয় হাতির হামলায়। এই পরিস্থিতি অনেক জটিল আকার ধারণ করেছে বন্যপ্রাণী নিজেদের আবাসভূমি হারিয়ে ফেলায়।
শিলিগুড়ির হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু ডিডাব্লিউকে বলেন, “দুর্যোগের জের এখনও চলছে। মানুষ বা বন্যপ্রাণী কেউ এখনো স্থিতধী হতে পারেনি। এখনই বলা যাবে না যে, মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণের সংঘাতের শেষ কবে হবে। এমনিতে অরণ্য ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসছে, তার মধ্যে এরকম একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তাতে বন্যপ্রাণীদের উপরে সাংঘাতিক স্ট্রেস বেড়েছে। বিশেষ করে বুনো শুয়োর স্বাভাবিক আশ্রয় থেকে বঞ্চিত, এমনকী খাবারও তারা পাচ্ছে না। এই স্ট্রেস কাটাতে তাদেরও যেমন সময় লাগবে, তেমনি মানুষেরও সময় লাগবে।”
ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা
এই স্ট্রেস বা মানসিক চাপ বন্যপ্রাণীদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। বাড়াতে পারে সংঘাতের পরিস্থিতি।কয়েক ঘন্টার প্লাবন ভবিষ্যতের জন্য আরো চিন্তা রেখে গিয়েছে।
অনিমেষ ব্যাখ্যা করেন, “বন্যায় বহু বন্যপ্রাণ বিপদে পড়ে। আবার এই বন্যা হয় বলে পলি জমে তাদের তৃণভূমির জোগান দেয়। জলদাপাড়া, কাজিরাঙায় এই ঘটনা ঘটেছে। আবার ডলোমাইট চূর্ণ এখন বহু এলাকা ঢেকে দিচ্ছে। ভুটানের ডলোমাইট মাইনিং থেকে ইদানীং বালি বা পলির বদলে ডলোমাইট চূর্ণ আসে। সেটা কৃষিজীবী মানুষের ফসল, চা বাগান, এমনকী বনাঞ্চলের জন্যও ক্ষতিকর। যে পরিমাণে ডলোমাইট আসছে, সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বনাঞ্চলের তৃণভূমিও ক্ষতির মুখে পড়বে। জলদাপাড়া, গরুমারা ইত্যাদি অভয়ারণ্যের গন্ডার, হাতি, বাইসন ইত্যাদি তৃণভোজী প্রাণী এই তৃণভূমির উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু ডলোমাইট চূর্ণ আসার ফলে এই তৃণভূমি বন্যপ্রাণীর পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এমন কোনো মেকানিজম নেই যে, তৃণভূমির উপরে যে পলি বা ডলোমাইট চূর্ণ পড়েছে তা পরিষ্কার করা যাবে।”
রাজ্য জীববৈচিত্র্য পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক অশোককান্তি সান্যাল ডিডাব্লিউকে বলেন, “বিপর্যয়ের ফলে ইকোসিস্টেম অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বলেই মানুষ এবং বন্যপ্রাণের সংঘাত বেধেছে। বন্যপ্রাণের আশ্রয়স্থলে জলের উপস্থিতি তাদের অন্য আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য করেছে। একটা ওভারঅল মাস্টার প্ল্যান আমাদের এখানে খুব একটা হয় না। সেটা তৈরি হলেও সার্থক রূপায়িত হয় না। জোড়াতালি দিয়ে কাজগুলো চালানো হয়। বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ না করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।”
এই পরিস্থিতিতে পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের ভূমিকা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে।
নন্দু বলেন, “প্লাবন এসেছে বন্যপ্রাণীর বিচরণভূমিতে। অর্থাৎ তাদের বাসস্থান গরুমারা জঙ্গলে বন্যা হয়নি, হয়েছে জলঢাকা নদীর চর সংলগ্ন এলাকাগুলোতে। প্রথম ধাক্কাটা সরীসৃপদের উপরেই আসে। ওদের বাসস্থানের সমস্যা তৈরি হয়। তাই মানুষের পরিত্যক্ত গৃহে ওরা এসে আশ্রয় নিচ্ছে। এই জায়গায় একটা সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বন দপ্তর এবং আমরা নজরদারি করছি। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সাপগুলোকে উদ্ধার করছি।”
কিন্তু কবে আবার সব স্বাভাবিক হবে, সেটা এখনই তারা বলতে পারছেন না।
অনিমেষ বলেন, “প্রকৃতি নিজের ক্ষত নিজেই সারিয়ে নেয়, কিন্তু তার জন্য সময় লাগবে। মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণের সংঘাত কোন জায়গায় থাকবে, এটা বলার জায়গায় এখনো আমরা নেই। এখন বেশ কিছু জায়গায় ফসল পাকছে। ফসল পাকলে হাতির সঙ্গে সংঘাত বেশি হয়। আরো কিছুদিন গেলে বোঝা যাবে, সেই সংঘাত বাড়লো না কমলো। প্রকৃতির ক্ষতি হওয়া মানে মানুষ এবং প্রাণীকুল, উভয়েরই ক্ষতি হওয়া।”
DW – 15.10.2025