রাশিয়ার তেলের ওপর নির্ভরতা কমানো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি চাপ এবং সম্ভাব্য শুল্কের মুখে ভারতের জ্বালানি নীতি এখন জটিল ভারসাম্যের খেলায় পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে—রাশিয়ার তেল ছাড়া ভারতের অর্থনীতি টিকতে পারবে কি?
মার্কিন শুল্ক ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন
আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, যা রাশিয়া থেকে তেল কেনার “শাস্তি” হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। এরপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগতভাবে রুশ তেল কেনা বন্ধের আশ্বাস দিয়েছেন।
রাশিয়া এ বিষয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানায়, আর ভারত ট্রাম্পের মন্তব্য থেকে দূরত্ব নেয়। দিল্লিতে রুশ রাষ্ট্রদূত ডেনিস আলিপভ বলেন, রুশ তেল ভারতের অর্থনীতির জন্য “খুবই উপকারী”। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তাদের তেল আমদানি নীতি নির্ধারিত হয় “দেশের ভোক্তার স্বার্থে, এক অনিশ্চিত জ্বালানি বাজারের প্রেক্ষাপটে।”

ভারতের তেল আমদানির চিত্র
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ ভারত গত বছর ৫২.৭ বিলিয়ন ডলারের রুশ তেল আমদানি করে, যা মোট তেল বিলের ৩৭ শতাংশ। এর পরের স্থানগুলোতে ছিল ইরাক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নাইজেরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র।
২০২১–২২ অর্থবছরে ভারতের শীর্ষ ১০ তেল সরবরাহকারী ছিল—রাশিয়া, ইরাক, সৌদি আরব, ইউএই, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কুয়েত, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া ও ওমান। বাকি ৩১টি দেশ ছিল ছোট আকারের অস্থায়ী সরবরাহকারী।
২০২৪ সালে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭.৭ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি পণ্য কেনে—এর মধ্যে ৪.৮ বিলিয়ন ডলারের ছিল অপরিশোধিত তেল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পেট্রোলিয়াম খাতে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৩.২ বিলিয়ন ডলারে।
ইরান ও ভেনেজুয়েলার পতন, রাশিয়ার উত্থান
২০১৮–১৯ থেকে ২০২১–২২ সময়কালে ভারতের তেল আমদানিতে বড় পরিবর্তন আসে। একসময় মোট আমদানির ১৭ শতাংশ (৪১ মিলিয়ন টন) সরবরাহ করত ইরান ও ভেনেজুয়েলা, কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের সরবরাহ বন্ধ হয়। তাদের জায়গা নেয় ইরাক, সৌদি আরব ও ইউএই।
এরপর ইউক্রেন যুদ্ধের পর দ্বিতীয় ধাক্কা আসে—রাশিয়ার তেল আমদানি ২০২১–২২ অর্থবছরের ৪ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ২০২৪–২৫ সালে ৮৭ মিলিয়ন টনে পৌঁছায়। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া ছাড় দেয়ায় ভারতীয় রিফাইনারিগুলোর কাছে রুশ তেল আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
২০২২–২৩ সালে রুশ তেলের গড় ছাড় ছিল ১৪.১ শতাংশ, আর ২০২৩–২৪ সালে ১০.৪ শতাংশ। এতে ভারত বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বা মোট তেল আমদানির ৩–৪ শতাংশ সাশ্রয় করে।

মধ্যপ্রাচ্যের শেয়ার কমলেও স্থিতিশীল সরবরাহ
ইরাক, সৌদি আরব ও ইউএইয়ের বাজার অংশীদারি ১১ শতাংশ কমলেও তাদের সরবরাহের মোট পরিমাণ প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। ভারতের মোট তেল আমদানি ১৯৬ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ২৪৪ মিলিয়ন টনে পৌঁছায়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কুয়েত, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া ও ওমানের সরবরাহ অর্ধেকে নেমে আসে।
গবেষক পার্থ মুখোপাধ্যায়ের মতে, “রাশিয়া থেকে আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক দেশ ভারতে তাদের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে হারিয়েছে।” অর্থাৎ, রাশিয়ার উত্থান হয়েছে অন্যদের ক্ষতির বিনিময়ে।
অর্থনৈতিক লাভ সীমিত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ
রাশিয়ার ছাড় দেওয়া তেল থেকে ভারতের সাশ্রয় মোট আমদানি বিলের ১ শতাংশেরও কম, কিন্তু পরিমাণে তা প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্লেষক মুখোপাধ্যায় বলেন, “যদি ভারত রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করে, তাহলে বৈশ্বিক তেলের দাম বেড়ে যাবে—যার প্রভাবে শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের জ্বালানি ব্যয়ও বাড়বে।” অর্থাৎ, রুশ তেল কিনে ভারত যেমন নিজের অর্থনীতি বাঁচাচ্ছে, তেমনি বিশ্ববাজারও কিছুটা স্থিতিশীল রাখছে।
দাম পতন ও বাজারের বাস্তবতা
চলতি বছরে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭৮ ডলার থেকে ৫৯ ডলারে নেমেছে—২৭ শতাংশ পতন। ফলে রাশিয়ার তেল বন্ধ হলেও বাজারে বড় ধাক্কা লাগার আশঙ্কা কম। কম চাহিদার কারণে অন্যান্য দেশ সহজেই ঘাটতি পূরণ করতে পারবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
রিফাইনারির উপযোগিতা ও কৌশলগত দ্বিধা
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রধান অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, “রাশিয়ার তেল ভারতের জন্য দাম স্থিতিশীল রাখে এবং রিফাইনারির প্রযুক্তির সঙ্গে ভালোভাবে খাপ খায়।”
ভারতের বেশিরভাগ রিফাইনারি ভারী তেল প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত, যেমন রাশিয়ার ইউরালস ব্লেন্ড। মার্কিন হালকা শেল তেল ব্যবহার করতে গেলে ব্যয়বহুল রিফাইনারি পরিবর্তন দরকার হবে এবং ডিজেল–জেট ফুয়েলের উৎপাদন কমে যাবে।

ভবিষ্যৎ দ্বিধা ও কূটনৈতিক মূল্য
ভারতের সামনে এখন কঠিন পছন্দ—রাশিয়ার ছাড় দেওয়া তেল কিনে মার্কিন প্রতিশোধের ঝুঁকি নেওয়া, নাকি ব্যয়বহুল মধ্যপ্রাচ্য ও মার্কিন তেলের দিকে ঝোঁকে ঘরোয়া জ্বালানি দামের ঊর্ধ্বগতি মেনে নেওয়া।
ওয়াশিংটনের চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দিল্লি পড়েছে কূটনৈতিক দোটানায়—বিলম্বিত ভারত–মার্কিন বাণিজ্যচুক্তি ঝুলে আছে, আর স্বল্পমেয়াদি লাভের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের খরচ এখন ভারতের জন্য এক কঠিন হিসাব।
#
ভারত_রাশিয়া_তেলনীতি, মার্কিন_চাপ, নরেন্দ্র_মোদি, রাশিয়া_তেল, ভারতীয়_অর্থনীতি, বৈশ্বিক_জ্বালানি, পার্থ_মুখোপাধ্যায়, অজয়_শ্রীবাস্তব, ডোনাল্ড_ট্রাম্প, জ্বালানি_কূটনীতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















