বিপ্লবের এক মাস পর নতুন সংকট
নেপালে গত সেপ্টেম্বরের তরুণ-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের এক মাস পর দেশটির রাজনীতি নতুন করে অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিতে পড়েছে। কেপি শর্মা ওলির সরকার উৎখাত এবং ৭০ জনের বেশি প্রাণহানির পর এখন প্রশ্ন উঠছে—এই বিপ্লব কি স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারবে, নাকি আদর্শগত বিভাজনে নিজেই ভেঙে পড়বে?
আদর্শগত দ্বন্দ্বে জর্জরিত তরুণ আন্দোলন
‘জেন জেড অ্যালায়েন্স’, ‘রিয়েল জেন জেড নেপাল’ ও ‘জেন জেড-ওয়াই-এক্স নেপাল’—এই তিনটি নতুন গোষ্ঠী বিপ্লবের পর প্রকাশ্যে এসেছে। কেউ প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান রক্ষায় সোচ্চার, কেউ ফেডারেল কাঠামো বিলোপের পক্ষে, আবার কেউ ২০০৮ সালে বিলুপ্ত হিন্দু রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাচ্ছে।
জেন জেড অ্যালায়েন্সের সদস্য ও আইনজীবী অর্ণব চৌধুরী (২৭) বলেন, “আমরা সংবিধান ভাঙতে চাই না; বরং তা শক্তিশালী করতে চাই। যারা আন্দোলনের নামে নিজেদের মতাদর্শ চাপিয়ে দিতে চায়, তাদের আমরা সহ্য করব না।”
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে কঠিন পথ
অভ্যুত্থানের পর সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তাঁর নেতৃত্বে ২০২৬ সালের মার্চে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।
কার্কির সরকার দুর্নীতি দমন ও রাজনৈতিক জবাবদিহির উদ্যোগে প্রশংসিত হলেও, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওলি, গৃহমন্ত্রী রমেশ লেখক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলায় দেরি হওয়ায় সমালোচনা বাড়ছে। ওলি ও লেখক উভয়েই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তরুণদের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বের দাবি
মন্ত্রীসভা সম্প্রসারণে অচলাবস্থা এবং তরুণদের উপেক্ষা নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। স্বাধীন বিশ্লেষক জে.বি. বিশ্বকর্মা বলেন, “এই সরকার জেন জেড আন্দোলনের ত্যাগের ভিত্তিতে গঠিত—তাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই ন্যায়ের প্রতীক।”
তবে বিশ্লেষকদের মতে, জেন জেড আন্দোলনে সংগঠিত নেতৃত্ব ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অভাব রয়েছে, যা তাদের রাজনৈতিক টিকে থাকার পথে প্রধান বাধা হতে পারে।
পুরনো নেতাদের পদত্যাগ ও নতুন বাস্তবতা
এই আন্দোলনের প্রভাবে নেপালের পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোতেও বড় পরিবর্তন এসেছে।
৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা, যাঁর বাড়িতে বিক্ষোভকারীরা হামলা চালিয়েছিল, তিনি নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর আগেই মাওবাদী কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ৭০ বছর বয়সী পুষ্পকমল দাহালও নিজের দল থেকে সরে দাঁড়ান।
বিশ্বকর্মা বলেন, “জেন জেড আন্দোলন রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি তুলতে সাহস জুগিয়েছে। এটি তাদের সাফল্য, তবে সমাজে প্রোথিত বৈষম্য ও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধেও তাদের লড়তে হবে।”
ওলির অনড় অবস্থান ও নতুন সংঘাতের ইঙ্গিত
যখন অন্য প্রবীণ নেতারা সরে গেছেন, ৭৩ বছর বয়সী কেপি শর্মা ওলি নিজের দল—কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফায়েড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট)—থেকে পদ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তিনি কার্কির নিয়োগকে “অবৈধ ও অসাংবিধানিক” বলে অভিহিত করে বিলুপ্ত সংসদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছেন।
অর্ণব চৌধুরী বলেন, “ওলির এই অবস্থান আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু আমরা থামব না; আন্দোলন চলবেই।”
বিশ্লেষকদের সতর্কবার্তা: সামনে আরও বিভাজন
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানী জীবন শর্মা সতর্ক করে বলেন, “জেন জেড গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের অভাব এবং রাজনীতির সঙ্গে দূরত্ব ভবিষ্যতে বিভাজন আরও বাড়াতে পারে।”
তিনি মনে করেন, সংবিধানের পথ থেকে সরে গেলে নেপাল আবারও বিশৃঙ্খলার দিকে যেতে পারে।
শর্মার মতে, সর্বোত্তম পরিস্থিতিতে দেশটি গণতান্ত্রিক সংস্কার ও প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার পথে এগোতে পারে; তবে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে নতুন জনতাবাদী গোষ্ঠীর উত্থান নেপালকে আরও পেছনে ঠেলে দেবে।
রাজতন্ত্রপন্থীদের উত্থান ও বিপদের আশঙ্কা
ডানপন্থী ও রাজতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো ইতোমধ্যেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দুর্নীতি ও সহিংসতার অভিযোগে জামিনে থাকা রাজতন্ত্রপন্থী কর্মী দুর্গা প্রসাই সতর্ক করেছেন, “এই রাজনৈতিক সংকট যদি চলতে থাকে, দেশ টুকরো হয়ে যাবে।”
ঐক্যের ডাক ও নতুন কৌশল
চরমপন্থী গোষ্ঠীর পুনরুত্থান নিয়ে জেন জেড নেতারা উদ্বিগ্ন। বিশ্লেষক বিশ্বকর্মা বলেন, “জেন জেড, রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তী সরকারকে অন্তত একটি ‘ন্যূনতম অভিন্ন এজেন্ডা’ নির্ধারণ করতে হবে—যেমন ২০০৫ সালের ১২ দফা চুক্তি দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ খুলে দিয়েছিল।”
তিনি যোগ করেন, “সরকারের উচিত সব পক্ষের মধ্যে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করা। তা না হলে নির্বাচনের আগেই দেশ আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।”
ভবিষ্যৎ নিয়ে জেন জেডদের ভাবনা
অর্ণব চৌধুরী বলেন, “আমরা সংলাপের জন্য প্রস্তুত, তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে দুর্নীতি দমন ও সুশাসন।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা আশাবাদী, কিন্তু শুধু আশা কোনো কৌশল নয়। এখন আমরা এমন এক পরিকল্পনা তৈরি করছি যা গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও সামাজিক ন্যায়ের মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ—যে নেপাল আমরা কল্পনা করেছি, সেটি গড়ার জন্য।”
# নেপাল_রাজনীতি, জেন_জেড_আন্দোলন, সুশীলা_কার্কি, কেপি_শর্মা_ওলি, প্রজাতন্ত্র, যুব_বিপ্লব, দক্ষিণ_এশিয়া, রাজনৈতিক_সংকট, সারাক্ষণ_রিপোর্ট