চিড়িয়াখানার প্রাণীরা বন্দী, সেটি সবাই জানে।
কিন্তু অনেকেই জানে না—চিড়িয়াখানার ভেতরের মানুষগুলোরাও বন্দী।
প্রশাসনিক ভয়, রাজনৈতিক প্রভাব আর অমানবিক কর্মপরিবেশের নিচে তারা বেঁচে থাকে নিঃশব্দভাবে, প্রতিদিন মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে।
ভয়, নীরবতা ও চাকরি হারানোর আশঙ্কা
একজন কর্মচারী, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, আমার কানে ফিসফিস করে বললেন—
“আমরা অনেক কিছু জানি, কিন্তু মুখ খুলি না। এখানে মুখ খোলা মানেই চাকরি হারানো।”
তার চোখে ভয় স্পষ্ট ছিল।
তিনি বললেন,
“প্রতিদিন কোনো না কোনো প্রাণী মরে। আমরা রিপোর্ট দিই, কিন্তু ঊর্ধ্বতনরা বলে: ‘লিখে দাও, প্রাকৃতিক মৃত্যু।’ আমরা কিছু করতে পারি না।”
চিড়িয়াখানার কর্মীদের অধিকাংশই অস্থায়ী চুক্তিতে কাজ করে।
তাদের বেতন নির্ভর করে কর্তৃপক্ষের মর্জির ওপর।
অসন্তুষ্টি মানেই বরখাস্ত।
ফল—এক নীরব যন্ত্রণা, যা প্রাণীদের খাঁচার বাইরেও বিস্তৃত।
চিকিৎসকের দ্বন্দ্ব: পেশা বনাম বিবেক
চিড়িয়াখানার ভেটেরিনারি চিকিৎসকও যেন বন্দী নিজের বিবেকের সঙ্গে।
একজন ডাক্তার বললেন,
“আমাদের কাছে ওষুধ নেই, বাজেট নেই, এমনকি সঠিক যন্ত্রও নেই।
একটা সিংহ অসুস্থ হলে কী করব? অ্যানাস্থেশিয়া নেই, স্ক্যান নেই, আর নির্দেশ আসে: ‘দেখে ফেলো, রিপোর্ট দাও।’”
তিনি চুপচাপ মাথা নিচু করলেন।
তার চোখে একধরনের অপরাধবোধ ছিল—যেন প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুতে তার নিজের অংশ আছে।
“আমি তাদের বাঁচাতে পারি না, শুধু মৃত্যুর সনদ লিখি,” বললেন তিনি নরম স্বরে।
এই স্বীকারোক্তি শুধু পেশাগত ব্যর্থতার নয়; এটি এক নৈতিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি।
শ্রমিকদের বাস্তবতা: পরিশ্রম, অবমাননা ও নীরব ক্ষোভ
যারা প্রতিদিন খাঁচা পরিষ্কার করে, প্রাণীদের খাবার দেয়, তাদের অবস্থাও করুণ।
তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে, গরমে ঘামে ভিজে যায়, তবু তাদের মজুরি অপ্রতুল।
কর্মীদের মধ্যে অনেকেই বছরের পর বছর কাজ করেও স্থায়ী নিয়োগ পায়নি।
একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী বললেন,
“প্রাণীরা মরে গেলে আমরাই সরাই, কিন্তু কেউ আমাদের গ্লাভস দেয় না।
আমরা হাত দিয়ে তুলতে বাধ্য হই, কারণ কাজ না করলে বেতন বন্ধ।”
গলা শুকনো, কিন্তু চোখে ছিল লজ্জা আর ক্লান্তি।
এই মানুষগুলোর শ্রমেই চিড়িয়াখানার ‘চলমানতা’ টিকে আছে, অথচ সমাজে তারা অদৃশ্য।
স্বেচ্ছাসেবকদের অসহায়তা
কিছু প্রাণীপ্রেমী তরুণ-তরুণী নিয়মিত আসেন সাহায্য করতে।
তারা খাবার দেয়, খাঁচা পরিষ্কার করে, কখনও নিজ খরচে ওষুধ কেনে।
কিন্তু তাদের প্রচেষ্টাও প্রশাসনিক দেয়ালে আটকে যায়।
একজন স্বেচ্ছাসেবক বললেন,
“আমরা বারবার বলেছি—প্রাণীদের চিকিৎসা ও মানসিক উদ্দীপনা দরকার।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ বলে: ‘আপনারা অপ্রয়োজনীয় চাপ দিচ্ছেন।’”
তিনি হেসে বললেন,
“আমরা প্রাণীদের জন্য কাজ করতে এসেছি, কিন্তু এখন মনে হয়, আমরা মানুষের সঙ্গে লড়ছি।”
ভয়ঙ্কর বাস্তবতা: প্রতিশোধের প্রশাসন
কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কথা বললে পরিণাম হয় ভয়াবহ।
এক প্রাক্তন কর্মচারী জানান,
“একবার আমি মিডিয়ায় বলেছিলাম যে সিংহদের খাবার কম দেওয়া হয়।
পরের দিনই আমার নামের পাশে লেখা হলো: ‘অসদাচরণের অভিযোগে বরখাস্ত।’”
চিড়িয়াখানার ভেতর তাই নীরবতা টিকে আছে প্রশাসনিক প্রতিশোধের ভয়েই।
যে মুখগুলো সত্য বলতে পারত, সেগুলো আজ বন্ধ।
চিড়িয়াখানার দুই রকম বন্দী
একদিকে খাঁচায় বন্দী প্রাণী, অন্যদিকে ভয় ও অভাবের খাঁচায় বন্দী মানুষ।
দু’জনেরই চোখে একই ক্লান্তি, একই অসহায়তা।
প্রাণীরা কথা বলতে পারে না, মানুষ চায় না বলতে।
ফলে পুরো প্রতিষ্ঠানটাই পরিণত হয়েছে এক সমাধিক্ষেত্রে—
যেখানে নীরবতা মানে টিকে থাকা, আর সত্য মানে শাস্তি।
নৈতিক পরিসমাপ্তি: কণ্ঠস্বরগুলো শোনা দরকার
চিড়িয়াখানার এই ভুলে যাওয়া কণ্ঠগুলো আসলে সমাজের প্রতিফলন।
আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে নীরব কর্মী—
অবিচারের সামনে দাঁড়িয়ে চুপ থাকি, যেন চুপ থাকাই নিরাপদ।
কিন্তু ইতিহাস বলে, নীরবতা কখনও মুক্তি দেয় না।
প্রাণীর মতোই মানুষও তখন বন্দী হয় নিজের ভয়ের মধ্যে।
এই কণ্ঠগুলোকে শোনা দরকার—
কারণ এই কণ্ঠই একদিন আমাদের মানবিকতার শেষ সীমানা রক্ষা করতে পারে।
#চিড়িয়াখানা #করাচি #প্রাণী_অধিকার #সারাক্ষণ_রিপোর্ট #KarachiZoo #AnimalRights #মানবিকতা #FeatureStory #WorkersRights #Fear #Voiceless #Ethics
আনিকা আতীক খান 





















