দুই বছরব্যাপী সংঘাতের পর গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল ১০ অক্টোবর। তবে জিম্মি বিনিময় সম্পন্ন হতেই আবারও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। একদিকে হামাসের বিরুদ্ধে নতুন হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল, অন্যদিকে গাজার কর্মকর্তারা অভিযোগ তুলেছেন—যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করছে ইসরায়েলি বাহিনী।
গাজায় নতুন সহিংসতা
গাজার সিভিল ডিফেন্স জানায়, শুক্রবার ইসরায়েলি ট্যাংক হামলায় গাজার জায়তুন এলাকায় অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে সাতজন শিশু ও তিনজন নারী ছিলেন। সংস্থাটির মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, “এদের আগে সতর্ক করা যেত, কিন্তু তা করা হয়নি।”
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র শনিবার দাবি করে, তাদের কাছে ‘বিশ্বস্ত তথ্য’ আছে যে হামাস নিজস্ব লোকজনের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল। যদিও হামাস এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে, যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করেছে—যদি হামাস যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে, তবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নেতানিয়াহুর ‘দ্বিতীয় ধাপ’ ঘোষণা
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু চ্যানেল ১৪-এ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যুদ্ধ তখনই সত্যিকারের শেষ হবে, যখন হামাস সম্পূর্ণ নিরস্ত্র হবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “এই দ্বিতীয় ধাপ বা ‘ফেজ বি’-তে হামাসকে নিরস্ত্র করা এবং গাজা উপত্যকাকে সামরিকভাবে নিরস্ত্রীকরণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।”
নেতানিয়াহুর এই মন্তব্য আসে ঠিক তখনই, যখন হামাস ১০ জন জিম্মির মরদেহ ফেরত দেয় এবং আরও দুইজনের দেহ ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয়।
জিম্মি বিনিময়ের সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, “যদি হামাস সব জিম্মিকে ফিরিয়ে না দেয়, তবে ইসরায়েল যুদ্ধ পুনরায় শুরু করতে পারে।”
যদিও এখন সব জিম্মি ফেরত এসেছে, ইসরায়েল তবুও সামরিক অভিযান পুনরায় শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ নিয়ে দোষারোপ
গাজার পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে—যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ইসরায়েল অন্তত ৪৭ বার যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে। এসব হামলায় ৩৮ জন নিহত ও ১৪৩ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে গাজার সিভিল ডিফেন্স।
তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “নাগরিকদের ওপর সরাসরি গুলি, উদ্দেশ্যমূলক শেল হামলা, গ্রেফতার অভিযানসহ নানা ধরনের লঙ্ঘন ঘটেছে। যুদ্ধ শেষ হলেও দখলদার বাহিনীর আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে।”
অন্যদিকে, ইসরায়েলও হামাসকে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করেছে, দাবি করেছে—হামাস যোদ্ধারা ‘হলুদ রেখা’ অতিক্রম করেছে, যা চুক্তির শর্ত ভঙ্গের সমান।

রাফাহ সীমান্ত বন্ধ: অবিশ্বাসের নতুন কারণ
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং “অনির্দিষ্টকালের জন্য” বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তে গাজা ও মিশরের মধ্যে মানবিক সাহায্য প্রবেশের একমাত্র পথ কার্যত বন্ধ হয়ে গেল।
ফিলিস্তিনি দূতাবাস জানিয়েছিল, সোমবার থেকে সীমান্ত খুলে দেওয়া হবে; কিন্তু ইসরায়েলি সরকার তা অস্বীকার করে। রাফাহ সীমান্তই এতদিন জিম্মি বিনিময় ও খাদ্যসহায়তা পৌঁছানোর একমাত্র রাস্তা ছিল।
যদি ইসরায়েল সীমান্ত বন্ধ রাখে, তবে দুর্ভিক্ষপীড়িত গাজার মানবিক সংকট আরও তীব্র হবে।
যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন
পর্যবেক্ষকদের মতে, যুদ্ধবিরতির টিকিয়ে রাখার মূল নির্ভরতা দুই পক্ষের সদিচ্ছার ওপর। এর আগেও, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে ইসরায়েল প্রথম যুদ্ধবিরতি ভেঙে আক্রমণ শুরু করেছিল।
এখন ট্রাম্পের প্রকাশ্য সমর্থন পেয়ে নেতানিয়াহু সরকারের পক্ষে আবারও সামরিক অভিযান চালানোর সম্ভাবনা প্রবল। তবে ট্রাম্প যদি সত্যিই শান্তিরক্ষায় ভূমিকা রাখতে চান এবং নোবেল পুরস্কারের প্রত্যাশা পূরণ করতে চান, তাহলে তাঁকেই হয়তো উদ্যোগ নিতে হবে—গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করে এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে।
দুই পক্ষের পারস্পরিক অবিশ্বাস, ক্রমাগত অভিযোগ ও সীমান্ত বন্ধের মতো পদক্ষেপে স্পষ্ট হয়ে উঠছে—গাজার যুদ্ধবিরতি আবারও ভঙ্গের মুখে। হামাস নিরস্ত্র না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল যুদ্ধ শেষ করবে না, আর হামাসও আত্মসমর্পণে রাজি নয়। ফলে শান্তির সময় যতই দীর্ঘায়িত হোক, নতুন সংঘাতের আশঙ্কা এখনই প্রকট হয়ে উঠেছে।
গাজা_যুদ্ধবিরতি, #ইসরায়েল_হামাস_সংঘাত, #দ্বিতীয়_ধাপ_অভিযান, #নেতানিয়াহু, #রাফাহ_সীমান্ত, #মানবিক_সংকট, #মধ্যপ্রাচ্য_রাজনীতি, #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















