রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক আন্তন মারদাসভ তেহরান টাইমসকে দেওয়া এক বিস্তারিত সাক্ষাৎকারে বলেন, রাশিয়া–ইরান অংশীদারিত্বের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের গভীরতার ওপর। রাজনৈতিক জোট ও সামরিক সহায়তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, উভয় দেশ অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থের ভারসাম্যের মধ্য দিয়ে সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখছে।
সম্পর্কের ওঠানামা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মারদাসভ বলেন, রাশিয়া ও ইরানের সম্পর্ক “শেয়ারবাজারের গ্রাফের মতো”—কখনো ঊর্ধ্বমুখী, কখনো নিম্নগামী। উভয় দেশই পশ্চিমা প্রভাবের বিপরীতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে, যা একধরনের ‘অ্যান্টি-গ্লোবালাইজেশন’ অংশীদারিত্বে রূপ নিয়েছে। তবে এই সম্পর্কেরও কিছু সীমা রয়েছে—যা শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নয়, বরং অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপরও নির্ভর করে।
তিনি উল্লেখ করেন, ২০০২ সালে রাশিয়া ইরানকে দশ বছর মেয়াদি বাণিজ্য ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা কর্মসূচির প্রস্তাব দিয়েছিল, যা ইরান গ্রহণ না করায় ২০০৭ সালের মধ্যেই তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই ধরনের ঘটনা দুই দেশের মধ্যে ‘অবিশ্বাস’ ও ‘সন্দেহ’ সৃষ্টি করে।
অর্থনৈতিক চুক্তির গুরুত্ব
মারদাসভ বলেন, ২০২৩ সালে ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (EAEU) ও ইরানের মধ্যে স্বাক্ষরিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। অথচ এই বাস্তব চুক্তিটিই রাজনৈতিক কৌশলগত অংশীদারিত্বের চুক্তির তুলনায় অনেক কম গুরুত্ব পেয়েছে। তার মতে, মিডিয়া সবসময় সামরিক বিষয়ে বেশি নজর দেয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্কই সামরিক সহযোগিতার সম্ভাবনাকে নির্ধারণ করে।
সামরিক সহযোগিতার সীমা
রাশিয়া ও ইরানের সামরিক সহযোগিতা মূলত প্রযুক্তিগত ও গোয়েন্দা স্তরে সীমাবদ্ধ। মারদাসভ বলেন, “রাশিয়া কখনোই ইরানের হয়ে সরাসরি যুদ্ধে নামবে না; ইরানও রাশিয়ার জন্য তা করবে না।”
রাশিয়ার সামরিক শিল্প এখন ইউক্রেন যুদ্ধের প্রয়োজন মেটাতে ব্যস্ত। অন্যদিকে, ইরানও ১২-দিনের সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় সরাসরি আক্রমণ না করে কৌশলগত সংযম দেখিয়েছে। তিনি মনে করেন, এই দুই দেশ বাস্তববাদী নীতিতে বিশ্বাসী এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা এড়াতেই সচেষ্ট।
নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
রাশিয়া ও ইরান উভয় দেশই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে পারস্পরিক সহায়তার কৌশল তৈরি করেছে। মারদাসভ উদাহরণ দেন, রাশিয়ায় ব্যবহৃত কামিকাজে ড্রোন, যা প্রথমে ইরান সরবরাহ করেছিল, এখন রাশিয়ার কারখানায় রুশ প্রযুক্তিতে তৈরি হচ্ছে। এতে রাশিয়া যেমন ইরানের ওপর নির্ভরতা কমিয়েছে, তেমনি ইরানও তার ড্রোন প্রযুক্তি উন্নত করার সুযোগ পেয়েছে।
প্রতিরক্ষা শিল্পে ইরানের অগ্রগতি
মারদাসভ বলেন, রাশিয়া বা চীন থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনা ইরানের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। বরং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইরানি প্রকৌশলীরা আধুনিক প্রযুক্তি শিখে নিজেদের প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নত করতে পারছে। তিনি জানান, ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড (IRGC) এখন নিজস্ব বিমান প্রতিরক্ষা ও সাঁজোয়া যান প্রকল্পে কাজ করছে।
তবে সাম্প্রতিক যুদ্ধে রাশিয়াপন্থী কয়েকজন ইরানি জেনারেলের মৃত্যু মস্কোতে নতুন প্রশ্ন তুলেছে—ইরানের সামরিক নেতৃত্ব কতটা আগের চুক্তিতে অনুগত থাকবে।
বাস্তববাদী কূটনীতি
মারদাসভ বলেন, ইরান ও রাশিয়া উভয়ই এখন বাস্তববাদী কূটনীতি অনুসরণ করছে। তারা পশ্চিমা ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর শক্তির ভারসাম্য দেখে পদক্ষেপ নেয়। তিনি মনে করেন, দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এখনও বিশাল, এবং ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের মতো কাঠামোর মাধ্যমে তারা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এড়িয়ে সহযোগিতা জোরদার করতে পারে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি
মারদাসভ মনে করেন, ইরান পুরোপুরি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে আগ্রহী নয়। তার মতে, ইরান এই কর্মসূচিকে আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক ইসরায়েল সংঘাতের পরেও ইরান উত্তর কোরিয়ার পথে হাঁটবে না—বরং নতুন সমঝোতার পথ খুঁজবে।
তিনি আরও বলেন, রাশিয়া ইরানকে কিছু পরামর্শ দিতে পারে, তবে মস্কো ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা দিচ্ছে—এ ধারণা ভুল। বরং, রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের বিরোধী।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ
মারদাসভ বলেন, রাশিয়া ও ইরানের ভবিষ্যৎ অংশীদারিত্বের ভিত্তি হতে হবে অর্থনীতি। শুধু প্রতিরক্ষা নয়, বাণিজ্য, জ্বালানি, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো খাতে পারস্পরিক বিনিয়োগই এই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে পারে।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের, গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক তাদের সরাসরি সংঘাত থেকে দূরে রাখে; তেমনি রাশিয়া ও ইরানের ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতা কৌশলগত স্থিতিশীলতার পথ তৈরি করতে পারে।
রাশিয়া ও ইরানের সম্পর্ক এখন ‘বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতার ভারসাম্যে’ দাঁড়িয়ে আছে। সামরিক সহযোগিতা বা রাজনৈতিক ঘোষণার চেয়ে অর্থনৈতিক সংহতিই তাদের সম্পর্ককে টেকসই করতে পারে—এটাই মারদাসভের মূল বার্তা।
#ট্যাগঃ #রাশিয়া_ইরান_সম্পর্ক, #আন্তন_মারদাসভ, #অর্থনৈতিক_সহযোগিতা, #ইউরেশিয়ান_ইকোনমিক_ইউনিয়ন, #মধ্যপ্রাচ্য_নীতি, #রুশ_কূটনীতি, #ইরান_পারমাণবিক_কর্মসূচি, #রাশিয়া_ইউক্রেন_যুদ্ধ, #সারাক্ষণ_রিপোর্ট