গত ১২ বছরে বাংলাদেশের সড়কে ঘটে যাওয়া ৬৭ হাজার ৮৯০টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এক লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন মানুষ, আহত হয়েছেন আরও এক লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা দিবস উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
সড়কে ‘গণহত্যা’, দায়ে দুর্নীতি ও নীতিগত ব্যর্থতা
ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা এখন “এক ধরনের গণহত্যা”তে পরিণত হয়েছে। তিনি এর জন্য দায়ী করেন দুর্নীতি, শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং ভুল নীতিনির্ধারণকে।
তার ভাষায়, “পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ কর্মকর্তার যোগসাজশ, চাঁদাবাজি, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা সড়ক পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছিল।”
অনুপযুক্ত যান, অদক্ষ চালক ও মাদকাসক্তদের দৌরাত্ম্য
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অচল বা অনুপযুক্ত যানবাহন, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও লাইসেন্সবিহীন চালক, নকশাগত ত্রুটিপূর্ণ সড়ক এবং মাদকাসক্ত চালক—এই সব কারণ মিলেই সড়ক দুর্ঘটনার পরিসর আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
২০১৪ থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ প্রাণহানি
মোজাম্মেল হক জানান, একই সময়ে গাজা যুদ্ধে প্রায় ৬৭ হাজার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, অথচ বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে তারও বেশি মানুষের। “এটি এক নীরব গণহত্যা,” বলেন তিনি।
সরকারি উদ্যোগে প্রশ্ন, সংস্কারহীন খাত
তিনি প্রশ্ন তোলেন, সরকারের বর্তমান উদ্যোগগুলো কতটা কার্যকর সড়কে মৃত্যুর এই ধারাবাহিকতা রোধে?
মোজাম্মেল হক বলেন, “সড়ককেন্দ্রিক নীতির ফলে নৌপথ ও রেলপথের মতো নিরাপদ বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা উপেক্ষিত হয়েছে। দাতা সংস্থার প্রভাবে নেওয়া প্রকল্পগুলো সড়ককে আরও জটিল করেছে।”
বেপরোয়া যানবাহনের বন্যা
সমিতির প্রতিবেদন বলছে, সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় ব্যাটারিচালিত তিনচাকা, মোটরসাইকেল, সিএনজি, নসিমন-করিমন ও রূপান্তরিত পিকআপের মতো অগণিত অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন সড়কে নেমে এসেছে। এতে জ্যাম ও দুর্ঘটনা উভয়ই বেড়েছে।
মন্ত্রীর ব্যর্থতা ও অব্যাহত অনিয়ম
তিনি সাবেক সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দীর্ঘ মেয়াদে কোনো কার্যকর সংস্কার না আনার সমালোচনা করেন। “সরকার পরিবর্তনের পরও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ বা ট্রাফিক বিভাগ—কোনো প্রতিষ্ঠানেই দৃশ্যমান সংস্কার হয়নি,” বলেন তিনি।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আইনসিদ্ধ করায় আশঙ্কা
সম্প্রতি সরকারের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বৈধকরণের সিদ্ধান্তকে তিনি “অসতর্ক পদক্ষেপ” হিসেবে উল্লেখ করে সতর্ক করেন, “যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হয়, এক বছরের মধ্যেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়বে।”
সমাধানের প্রস্তাব: মেট্রো ও বিআরটি লেন
মোজাম্মেল হক প্রস্তাব দেন, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো সিস্টেম চালু করা এবং ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে অন্তত দুইটি বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেন স্থাপন করতে হবে। এর সঙ্গে যুক্ত করা উচিত ডিজিটাল ভাড়া ব্যবস্থা।
তার মতে, “এমন পদক্ষেপ সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে, দুর্ঘটনা কমাবে, যানজট হ্রাস করবে এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।”
#
বাংলাদেশ, সড়ক দুর্ঘটনা, যাত্রী কল্যাণ সমিতি, মোজাম্মেল হক, সড়ক নিরাপত্তা, বিআরটি, মেট্রো রেল, ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি