মার্কিন ডলারের প্রভাব আগামী বছরগুলোতে ধীরে ধীরে দুর্বল হবে বলে সতর্ক করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ এল-এরিয়ান। তাঁর মতে, বিশ্ব অর্থনীতি এখন আর একক কেন্দ্রভিত্তিক নয়— বরং এটি দ্রুত আঞ্চলিক ও বিভাজিত কাঠামোর দিকে এগোচ্ছে।
ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্যে পরিবর্তন আসছে
আলিয়াঞ্জের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. এল-এরিয়ান ‘শারজাহ ইনভেস্টমেন্ট ফোরাম ২০২৫’-এর এক সেশন-এ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন ডলারকেন্দ্রিক বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা এখন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নতুন বাণিজ্য ও পেমেন্ট নেটওয়ার্ক তৈরি হওয়ায় অর্থনৈতিক ভারসাম্য নতুনভাবে গঠিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, “ডলারের বিকল্প কোনো মুদ্রা এখনো নেই। তাই বৈশ্বিক অর্থনীতির কেন্দ্রে এটি থাকবেই, কিন্তু এর প্রভাব ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে।”
এল-এরিয়ানের ব্যাখ্যায়, বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামো এতদিন ছিল “মূল ও প্রান্ত” (core-periphery) ধারণার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু এখন চীনসহ কয়েকটি দেশ মধ্যভাগে থাকা যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে নতুন আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক “ছোট পাইপলাইন” তৈরি করছে। এগুলো সরাসরি মার্কিন প্রভাব প্রতিস্থাপন করছে না, তবে এর কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল করছে।
তিনটি বৈশ্বিক ঝুঁকি
নীতিনির্ধারকদের জন্য প্রধান তিনটি ঝুঁকি তুলে ধরেন এল-এরিয়ান:
১. বৈশ্বিক ব্যবস্থার বিভাজন,
২. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, এবং
৩. যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রমবর্ধমান রাজস্ব ঘাটতি।
তিনি বলেন, “প্রথম ঝুঁকি হলো— বৈশ্বিক ব্যবস্থার ভাঙন। দ্বিতীয়টি হলো— এআইয়ের ‘৮০-২০ সূত্র’। যেখানে ৮০ শতাংশ ইতিবাচক, কিন্তু ২০ শতাংশ বিপজ্জনক।”
এল-এরিয়ানের মতে, সরকারগুলোর উচিত উদ্ভাবন ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। তাঁর ভাষায়, “আমেরিকায় তারা ভালো দিকের প্রেমে পড়ে গিয়ে ঝুঁকি-ব্যবস্থাপনা ভুলে যায়, আর ইউরোপে তারা এতটাই সতর্ক হয় যে, উন্নয়নই রুদ্ধ হয়ে যায়।”
তৃতীয় ঝুঁকি হিসেবে তিনি বলেন, “ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনীতি যত দিন বিশাল বাজেট ঘাটতি নিয়ে চলবে, তত দিন বন্ড বাজারের আস্থা ধরে রাখা কঠিন হবে।” ফ্রান্সের সাম্প্রতিক ক্রেডিট রেটিং হ্রাসকে তিনি এর এক উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
ভারতের উত্থান ও নতুন সুযোগের কেন্দ্র
বিশ্বব্যাপী এই পরিবর্তনের সময় ভারতকে তিনি সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল বড় অর্থনীতি হিসেবে বর্ণনা করেন। এল-এরিয়ানের মতে, ভারতের জনসংখ্যা ও উৎপাদনশীলতা মিলিয়ে দেশটি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যা অতীতে চীনের প্রবৃদ্ধির ধারা স্মরণ করিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, “ভারতীয় বাজার আগামী পাঁচ বছরে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোর একটি হয়ে উঠবে।”
একই সঙ্গে তিনি গালফ অঞ্চল, বিশেষত সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বকে প্রশংসা করে বলেন, “এ দেশটি সময়ের আগেই বৈশ্বিক পরিবর্তনের দিকটি ধরতে পেরেছে এবং দূরদর্শী নেতৃত্ব ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে।”
ছোট ও দ্রুত অভিযোজ্য অর্থনীতির শক্তি
এল-এরিয়ান ব্যাখ্যা করেন, সিঙ্গাপুর ও ইউএইয়ের মতো ছোট কিন্তু চটপটে অর্থনীতিগুলো তাদের আকারকে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধায় পরিণত করতে পেরেছে— অভিযোজন ক্ষমতা থাকলেই স্কেল কার্যকর হয়।
শারজাহর অদেখা সম্ভাবনা
আলোচনার সঞ্চালক শেখ ফাহিম আল কাসিমি জানান, ২০২৪ সালে শারজাহর অর্থনীতি ৮.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মধ্যে শুধু লজিস্টিকস খাতেই প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ।
নীতিনির্ধারকদের জন্য তাঁর পরামর্শ জানতে চাইলে এল-এরিয়ান বলেন, “শারজাহকে তার সম্ভাবনা ও অবস্থান নিয়ে আরও জোরালোভাবে কথা বলতে হবে। অনেকেই জানে না, এখানে কত বৈচিত্র্যময় কার্যক্রম চলছে যা ভবিষ্যতের জন্য দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করছে।”
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “ইউরোপের অনেক অঞ্চলে স্থবিরতা দেখা গেলেও উপসাগরীয় দেশগুলো ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক মানচিত্রে নিজেদের অবস্থান শক্তভাবে তৈরি করছে।”
বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক বিভাজনের পথে এগোচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক একক আর্থিক ব্যবস্থার যুগ ধীরে ধীরে শেষের দিকে। তবে নতুন বাস্তবতায়, ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মতো উদীয়মান শক্তিগুলোর সাফল্য নির্ভর করবে তাদের অভিযোজন ও দূরদর্শী নীতিনির্ধারণের ওপর।
#ডলার, বিশ্ব অর্থনীতি, মোহাম্মদ এল-এরিয়ান, শারজাহ ইনভেস্টমেন্ট ফোরাম, বৈশ্বিক ঝুঁকি, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সারাক্ষণ রিপোর্ট