সকালবেলার উদ্বেগ
গতকাল শুক্রবার সকালবেলা, মিরপুর ১ নম্বর কাঁচাবাজারের পথে হাঁটছিলেন আবুল হোসেন। হাতে পাতলা কাপড়ের ব্যাগ, মুখে অগভীর এক দীর্ঘশ্বাস। সারাটা সপ্তাহ অফিসে বসে যেভাবে হিসাবের খাতা মেলান, আজ সেই হিসাব মিলাতে এসেছেন বাজারে—কিন্তু বাজার যেন আর হিসাব মানে না।
বৃষ্টির অজুহাতে গত দুই মাস ধরে সবজির দাম ঊর্ধ্বমুখী। ভেবেছিলেন এবার হয়তো কিছুটা স্বস্তি মিলবে, কিন্তু টমেটোর দাম শুনে তাঁর চোখ বিস্ফারিত—দেশি টমেটো ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি, ভারতীয় টমেটো ১২০ টাকা। বেগুনের কেজি ২০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে, ধনেপাতা ৩০০ টাকা, কাঁচা মরিচ ২০০ টাকা। আর যে করলা একসময় ৩০ টাকায় মিলত, আজ সেটাও ৮০ টাকায়।
“এই দেশে কিছুই ঠিকঠাক চলে না,” বিড়বিড় করলেন আবুল হোসেন, কাঁধের ব্যাগে পঞ্চাশ টাকার শাকপাতা রাখতেই।
সবজির রঙে অর্থনীতির কালো দাগ
শসা, পটোল, ঢ্যাঁড়স—সবজির একেকটা নাম শুনলেই মনে হয় যেন বিলাসপণ্যের তালিকা পড়ছেন। পাশের এক বিক্রেতা সাদা বেগুন দেখিয়ে বলল, “ভাই, এটা ১২০ টাকা কেজি।”
আবুল হাসলেন, কিন্তু হাসিটা যেন গলায় আটকে গেল। মনে মনে ভাবলেন, “এই দাম শুনে হাসা যায় নাকি!”

একটু দূরে আরেক ক্রেতা নাহিয়ান বলছিলেন, “এই বাজার কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সরকার আসে যায়, কিন্তু দাম শুধু বাড়ে।”
আবুল মাথা নাড়লেন। সেই মাথা নাড়ায় ছিল ক্ষোভ, অসহায়তা আর একরাশ নীরব প্রতিবাদ।
মাছ-মাংসেও আগুন
সবজির পরে গেলেন মাছের দোকানে। রুই ৫০০ টাকা, চিংড়ি ১,০০০ টাকার ওপরে। গরুর মাংস ৭৮০, খাসির ১,২০০, কক মুরগি ২৮০—প্রতিটি দাম যেন তাঁর মাসের বেতনের প্রতি অবমাননা।
“ভাই, দেশি মুরগি দিন তো এক কেজি,” বললেন আবুল।
বিক্রেতা হাসল, “৫৫০ টাকা কেজি, ভাই। খাবেন, না দেখবেন?”
আবুল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মুরগির দিকে। তারপর চুপচাপ চলে গেলেন পাশের দোকানে—ডিম কিনবেন ভেবে। কিন্তু ডিমের দামও কম নয়, লাল ডিম ডজনপ্রতি ১৩০ টাকা। মাথা নিচু করে ফিরে এলেন।
রসুনে রস নেই, পেঁয়াজে চোখে জল
রসুনের দোকানে দাঁড়িয়ে আবুলের চোখে সত্যি জল এসে গেল—দেশি রসুন ১২০ টাকা, চায়না রসুন ১৮০, আদা ২০০ টাকা। বিক্রেতা লিটন সাহেব হেসে বললেন, “নতুন ফসল এলেই দাম কমবে।”
আবুল মনে মনে বললেন, “নতুন ফসল আসবে, কিন্তু নতুন সরকার কবে আসবে? সেই দাম কমাবে কে?”
বাড়ি ফিরে স্ত্রীর মুখোমুখি হতে ভয় লাগছিল। জানেন, আজকের বাজারের হিসাবটা সংসারের মাসিক খরচের খাতায় আর মেলানো যাবে না।

৫. শাসনের অভাব, স্বপ্নের অনিশ্চয়তা
বাজার থেকে ফেরার পথে আবুলের মনে হলো, এই লাগামহীন দাম যেন কেবল সবজির নয়—পুরো অর্থনীতির।
প্রতিদিন সকালে সংবাদে উন্নয়নের গল্প, কিন্তু বিকেলের বাজারে দেখা যায় সেই উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি—চড়া দাম, ক্লান্ত মুখ আর নিঃশব্দ ক্ষোভ।
তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন, “এই দেশে যদি একটা কাঁচা টমেটো ১৪০ টাকা হয়, তাহলে মানুষের জীবনের দাম কত?”
রাস্তার ধারে এক বাচ্চা কলা বিক্রি করছিল—প্রতি হালি ৪০ টাকা। বাচ্চাটার চোখে ক্ষুধা, তবু হাসি।
আবুলের মনে হলো, হাসিটাই এখন এই দেশের সবচেয়ে দামী জিনিস।
সেদিন রাতের খাবারে টেবিলে ছিল অল্প ডাল, দুই টুকরো আলু আর কিছু ভাজা শাক। টেলিভিশনে অর্থমন্ত্রী বলছিলেন, “অর্থনীতি স্থিতিশীল পথে আছে।”
আবুল হোসেন চামচটা নামিয়ে ফেললেন। মনে মনে বললেন,
“স্থিতিশীল তো বটেই—শুধু আমরা, সাধারণ মানুষ, পড়ে আছি স্থির হয়ে। না হেসে, না কেঁদে।”
#বাজার #অর্থনীতি #মূল্যবৃদ্ধি #সরকারি_ব্যর্থতা #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















