ভেনেজুয়েলা ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাড়তে থাকা উত্তেজনার মধ্যেই দক্ষিণ আমেরিকায় বিশাল সামরিক শক্তি প্রদর্শনে নামল যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্বের বৃহত্তম ও আধুনিকতম বিমানবাহী রণতরী “জেরাল্ড ফোর্ড”-কে লাতিন আমেরিকায় পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে— যা মার্কিন ইতিহাসে এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় সামরিক মোতায়েন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বাড়ছে
ওয়াশিংটন, ২৪ অক্টোবর — প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি আরও জোরদার করতে নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে। শুক্রবার তারা ঘোষণা দেয়, বিশ্বের বৃহত্তম ও আধুনিকতম বিমানবাহী রণতরী “জেরাল্ড ফোর্ড”-কে লাতিন আমেরিকায় পাঠানো হচ্ছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় সামরিক মোতায়েন, যা পূর্বের যেকোনো মাদকবিরোধী অভিযানের চেয়েও অনেক বেশি পরিসরে পরিচালিত হবে।

যুদ্ধজাহাজ, পারমাণবিক সাবমেরিন ও যুদ্ধবিমানসহ বিশাল বহর
এই মোতায়েনের মাধ্যমে ইতিমধ্যে সেখানে অবস্থানরত আটটি যুদ্ধজাহাজ, একটি পারমাণবিক সাবমেরিন এবং একাধিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের সঙ্গে নতুন বাহিনী যোগ হচ্ছে। ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলার সরকারকে মাদক পাচারকারীদের আশ্রয় দেওয়া ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছে।
পেন্টাগনের মুখপাত্র শন পারনেল বলেন, “দক্ষিণ কমান্ডের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন উপস্থিতি অবৈধ কর্মকাণ্ড শনাক্ত, নজরদারি ও প্রতিহত করার সক্ষমতা বাড়াবে— যা আমাদের দেশ ও পশ্চিম গোলার্ধের নিরাপত্তা রক্ষায় সহায়ক হবে।”
তিনি যদিও রণতরির সুনির্দিষ্ট যাত্রার তারিখ জানাননি, তবে কয়েকদিন আগেও এটি ইউরোপের জিব্রালটার প্রণালীর মধ্য দিয়ে চলছিল বলে জানা গেছে।
৫,০০০ নাবিকসহ বিশ্বের বৃহত্তম রণতরী
২০১৭ সালে কমিশনপ্রাপ্ত ‘জেরাল্ড ফোর্ড’ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ও সবচেয়ে উন্নত বিমানবাহী রণতরী, যাতে ৫,০০০-রও বেশি নাবিক রয়েছে। এতে ৭৫টিরও বেশি যুদ্ধবিমান, উন্নত রাডার ব্যবস্থা এবং মাঝারি পাল্লার ‘ইভলভড সি স্প্যারো’ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা ড্রোন ও আকাশ থেকে আসা হুমকি প্রতিহত করতে ব্যবহৃত হয়।
এ ছাড়া বহরে রয়েছে ‘নরম্যান্ডি’ নামের একটি টাইকনডেরোগা-শ্রেণির গাইডেড মিসাইল ক্রুজার এবং আরও চারটি আর্লি বার্ক-শ্রেণির ডেস্ট্রয়ার— ‘থমাস হাডনার’, ‘র্যামেজ’, ‘কার্নি’ ও ‘রুজভেল্ট’। এসব জাহাজের মাধ্যমে আকাশ প্রতিরক্ষা, জাহাজবিধ্বংসী ও সাবমেরিনবিরোধী অভিযানে সমন্বিত সক্ষমতা তৈরি হবে।

মাদকবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি তৎপরতা
সেপ্টেম্বরের শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত ১০টি অভিযানে সন্দেহভাজন মাদকবাহী নৌযানকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে, যাতে প্রায় ৪০ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু ভেনেজুয়েলার নাগরিকও ছিলেন বলে জানিয়েছে পেন্টাগন।
এই পদক্ষেপগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতি নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আইনি বিশেষজ্ঞ ও কিছু ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন— এসব হামলা কি না আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মাদুরোর হুঁশিয়ারি
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করছে। বৃহস্পতিবার তিনি সতর্ক করে বলেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র কখনো ভেনেজুয়েলায় হস্তক্ষেপ করে, শ্রমজীবী মানুষরা বিদ্রোহে নামবে এবং সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘট ঘোষণা করবে। তখন লক্ষ লক্ষ সশস্ত্র নাগরিক দেশব্যাপী মিছিল করবে।”
আগস্ট মাসে ওয়াশিংটন মাদুরোর গ্রেপ্তারে সহায়ক তথ্যের বিনিময়ে পুরস্কার দ্বিগুণ করে ৫০ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করে, তাকে মাদক ও অপরাধচক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্ত করে— যা মাদুরো অস্বীকার করেন।
কলম্বিয়া-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা
একই সঙ্গে কলম্বিয়ার সঙ্গেও উত্তেজনা তীব্র হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রোকে “অবৈধ মাদক নেতা” ও “খারাপ ব্যক্তি” হিসেবে আখ্যা দেন। কলম্বিয়া এই মন্তব্যকে “অপমানজনক ও অগ্রহণযোগ্য” বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
পেন্টাগনের মুখপাত্র জানান, “নতুন বাহিনী মাদক পাচার বন্ধে ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধচক্র ধ্বংসে বিদ্যমান সক্ষমতাকে আরও জোরদার করবে।”
গোপন অভিযানে সিআইএ
ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলায় গোপন অভিযান চালানোর অনুমতি সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ)-কে দিয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ রণতরী মোতায়েনের ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট পেত্রোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
আইনি বিতর্কের মধ্যেও সমর্থন
শুক্রবার হেগসেথ জানায়, সাম্প্রতিক এক অভিযানে ছয়জন সন্দেহভাজন “নারকো-সন্ত্রাসী” নিহত হয়েছে। যদিও আইনি মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে এসব অভিযান ‘যুদ্ধঘোষণা ছাড়াই’ পরিচালিত হওয়ায় তা আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না।
অন্যদিকে রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান রিক ক্রফোর্ড এক্স এ লিখেছেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমাদের দেশ ও পশ্চিম গোলার্ধের নিরাপত্তায় কোনো ছাড় দিচ্ছেন না।”

সীমিত সম্পদ, দীর্ঘ পরিকল্পনা
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে মাত্র ১১টি বিমানবাহী রণতরী রয়েছে, যেগুলোর কার্যসূচি সাধারণত অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। গত বছর “ইউএসএস জর্জ ওয়াশিংটন” দক্ষিণ আমেরিকায় মোতায়েন করা হয়েছিল, তবে সেটি ছিল পূর্বনির্ধারিত মহড়ার অংশ।
বিশ্লেষণ: নতুন কৌশল না কি চাপের রাজনীতি?
এই মোতায়েন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ আমেরিকান নীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ওয়াশিংটন বলছে, এটি মাদকবিরোধী লড়াইয়ের অংশ; কিন্তু সমালোচকদের মতে, এটি মূলত ভেনেজুয়েলা ও তার মিত্রদের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল।
বড় প্রশ্ন এখন— এই সামরিক শক্তি প্রদর্শন আসলেই কি অঞ্চলের স্থিতিশীলতা আনবে, নাকি আরও সংঘাত উসকে দেবে?
# যুক্তরাষ্ট্র, ভেনেজুয়েলা, দক্ষিণ_আমেরিকা, ট্রাম্প, মাদকবিরোধী_অভিযান, আন্তর্জাতিক_রাজনীতি, পেন্টাগন, রণতরী, জেরাল্ড_ফোর্ড, সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















