চীনের অন্যতম বৃহৎ রেয়ার আর্থ উৎপাদক ‘চায়না রেয়ার আর্থ গ্রুপ’ সরকারের নির্দেশনা মেনে কঠোর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার মাঝেই এ পদক্ষেপ বেইজিংয়ের নীতিকে আরও দৃঢ় করেছে, যা বৈশ্বিক শিল্পে চীনের আধিপত্যকে স্থিতিশীল রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ঘোষণায় সরকারের অবস্থান আরও দৃঢ়
চীনের অন্যতম বৃহৎ রেয়ার আর্থ উৎপাদক চায়না রেয়ার আর্থ গ্রুপ জানিয়েছে, তারা সরকারের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করবে। সাম্প্রতিক মার্কিন সমালোচনার মধ্যেই এই ঘোষণা বেইজিংয়ের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে।
২০২১ সালে গঠিত রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থা জানায়, জটিল ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ বৈদেশিক পরিস্থিতিতে সব কার্যক্রম আইন ও বিধিবিধান মেনে পরিচালিত হবে, যাতে জাতীয় নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় থাকে। প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছরের শেষ প্রান্তিকে ‘নিয়ন্ত্রক নির্দেশনা মেনে চলা’কে প্রধান কর্মপরিকল্পনা হিসেবে ঘোষণা করেছে।

অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ: দীর্ঘমেয়াদি নীতি, পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম
বেইজিংয়ের ইউনিভার্সিটি অব ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের অধ্যাপক গং শিওং মনে করেন, চীনের রেয়ার আর্থ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ একটি দীর্ঘমেয়াদি নীতি, যা শিগগিরই পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তিনি বলেন, “বাস্তবায়নে কিছু নমনীয়তা আসতে পারে—যেমন অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজ করা বা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল স্থিতিশীল রাখতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া। তবে তা নির্ভর করবে আসন্ন বৈদেশিক বাণিজ্য আলোচনার অগ্রগতির ওপর।”
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বৈঠকের আগে কৌশলগত চাপ
চীনের এই ঘোষণা এমন সময়ে এসেছে, যখন রেয়ার আর্থ সরবরাহ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। হোয়াইট হাউস নিশ্চিত করেছে, ৩০ অক্টোবর, দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
রেয়ার আর্থ খনিজ প্রক্রিয়াকরণে চীনের প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য দেশটিকে এই আলোচনায় শক্তিশালী অবস্থানে রেখেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাল্টা পদক্ষেপের ভাবনা
চীনের নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নও পাল্টা ব্যবস্থা বিবেচনা করছে।
ইইউ অর্থনীতিবিষয়ক কমিশনার ভালদিস দোমব্রভস্কিস জার্মান দৈনিক হ্যান্ডেলসব্ল্যাট পত্রিকাকে বলেন, “আমরা অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন সম্ভাব্য পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করছি। এখনো কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থা ঘোষণা করা হয়নি, তবে আলোচনা চলছে।”

বৈশ্বিক শিল্পে রেয়ার আর্থের অপরিহার্য ভূমিকা
রেয়ার আর্থ উপাদানগুলো উচ্চপ্রযুক্তি পণ্যের অপরিহার্য কাঁচামাল—যেমন বৈদ্যুতিক মোটর, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সামরিক প্রযুক্তি। অটোমোবাইল শিল্পে এসব উপাদান থেকে তৈরি স্থায়ী চুম্বক ব্যবহার হয় ফুয়েল সেন্সর, স্পিকার, মোটর ও পাওয়ার ট্রেনে—বিশেষ করে বৈদ্যুতিক যানবাহনে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আলিক্সপার্টনার্সের তথ্য অনুযায়ী, চীন বর্তমানে বৈশ্বিক রেয়ার আর্থ খনির ৭০ শতাংশ, পরিশোধন সক্ষমতার ৮৫ শতাংশ এবং অ্যালয় ও চুম্বক উৎপাদনের ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও বাজারে প্রভাব
চীন চলতি মাসের শুরুতে আরও পাঁচটি মধ্য-ভারী রেয়ার আর্থ উপাদানকে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ তালিকায় যুক্ত করেছে। পাশাপাশি এসব খনিজের উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিকেও নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হয়েছে।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, চীনা প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি কিংবা চীন-উৎপন্ন রেয়ার আর্থের নির্দিষ্ট অনুপাতের বেশি থাকা যেকোনো পণ্যকেও রপ্তানির আগে লাইসেন্স নিতে হবে, উৎপত্তি দেশ যাই হোক না কেন।
ফলে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হালকা রেয়ার আর্থ যেমন নিয়োডিমিয়ামের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে, আর প্রতিরক্ষা শিল্পে ব্যবহৃত ভারী রেয়ার আর্থের বাজারে ঘাটতি আরও প্রকট হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রেয়ার আর্থ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ চীনের একটি কৌশলগত হাতিয়ার, যা বেইজিংকে বৈশ্বিক বাণিজ্য আলোচনায় আরও শক্তিশালী অবস্থানে রাখবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাল্টা প্রতিক্রিয়া যতই কঠোর হোক না কেন, এই নীতির শিগগির কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
#চীন #রেয়ার_আর্থ #রপ্তানি_নিয়ন্ত্রণ #যুক্তরাষ্ট্র_চীন_বাণিজ্য #বেইজিং_নীতি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















