বিশ্বজুড়ে অস্থায়ী অভিবাসন দ্রুত বাড়ছে। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি কর্ম ভিসার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখে। শুধু অভিবাসন-বান্ধব দেশই নয়, অভিবাসনবিরোধী মনোভাব থাকা হাঙ্গেরি, ইতালি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও এখন অতিথি শ্রমিকদের স্বাগত জানাচ্ছে।
অভিবাসনকে ঘিরে শঙ্কা ও বাস্তবতা
পশ্চিমা দেশগুলোতে অস্থায়ী অভিবাসন অনেকের কাছে বিতর্কিত বিষয়। অনেকে মনে করেন, এই কর্মীরা স্বল্প মজুরিতে দীর্ঘসময় কঠোর পরিশ্রম করেন। মাঝে মাঝে পাসপোর্ট আটকে রাখা বা গৃহকর্মীদের নির্যাতনের খবর শিরোনাম হয়। তবে সঠিকভাবে নকশা করা অস্থায়ী কর্মী প্রকল্প শ্রমিক, নিয়োগকর্তা ও সরকার—সব পক্ষের জন্যই লাভজনক। রাজনৈতিকভাবে অভিবাসনবিরোধী পরিবেশেও এসব প্রকল্প নিম্নদক্ষ শ্রমিকদের গ্রহণের কার্যকর উপায় হয়ে উঠছে।
জনমিতির চাপে শ্রমিকের চাহিদা
আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালির মতো দেশে জনসংখ্যার বার্ধক্য শ্রমবাজারে বড় সংকট তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী পেতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই ইতালি ও অন্যান্য দেশ এখন কম দক্ষ অভিবাসীদের বিপুল সংখ্যায় অস্থায়ী ভিসা দিচ্ছে। যদিও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান স্থায়ী বসবাসের সুযোগ সীমিত রেখেছে, তবু তারা প্রতিবছর লাখ লাখ অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে।

কল্যাণ ব্যয়ের উদ্বেগ
অনেকেই আশঙ্কা করেন, নিম্নদক্ষ অভিবাসীরা সরকারি কল্যাণ ব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি করবে। বাস্তবে অভিবাসনের আর্থিক প্রভাব নির্ভর করে শ্রমিকদের দক্ষতা ও তাদের কল্যাণসুবিধা পাওয়ার নিয়মের ওপর। উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি অভিবাসীরা সাধারণত পেনশন ও স্বাস্থ্যসেবা পান, কিন্তু উচ্চদক্ষদের তুলনায় কম কর দেন। কিছু দেশ যেমন উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো, কল্যাণসুবিধা সীমিত রাখে; আবার কেউ কেউ শ্রমিকদের অবসরের আগেই দেশে ফেরত পাঠায়। এ কারণে অতিথি শ্রমিক প্রকল্প জনপ্রিয় হচ্ছে।
উৎস দেশের লাভ
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের ল্যান্ট প্রিচেটের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে নিম্নদক্ষ শ্রমে নিযুক্ত অভিবাসীরা নিজ দেশে থাকার তুলনায় পাঁচগুণ বেশি আয় করতে পারেন, স্থানীয় ক্রয়ক্ষমতা হিসাবেও তা বহুগুণ বেশি। যদি উন্নত দেশগুলোর শ্রমঘাটতির দুই-তৃতীয়াংশ অস্থায়ী কর্মী দিয়ে পূরণ করা যায়, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক আয় বাড়বে প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। আর উৎস দেশগুলো বিপুল রেমিট্যান্স পেয়ে ব্যবসা, শিক্ষা ও পরিবারিক উন্নয়নে তা বিনিয়োগ করছে—যার পরিমাণ তাদের মোট জিডিপির প্রায় ৫.৪ শতাংশ।
নীতি সংস্কার ও নমনীয়তা জরুরি
অস্থায়ী অভিবাসন আরও গ্রহণযোগ্য করতে হলে প্রকল্পগুলোতে সংস্কার দরকার। অনেক দেশে এখনো নমনীয়তার অভাব রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কাফালা পদ্ধতিতে শ্রমিক কেবল এক নিয়োগকর্তার অধীন থাকেন—চাকরি হারালে তাকে দেশে ফিরতে হয়। সৌদি আরব এই কাঠামো বদলে কর্মীদের বেশি স্বাধীনতা দিয়েছে, ফলে বাজারে গতিশীলতা বেড়েছে।
অস্ট্রেলিয়া সম্প্রতি শ্রমিকদের নতুন নিয়োগকর্তা খোঁজার সময়সীমা ৬০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৮০ দিন করেছে। এ ধরনের পরিবর্তন কর্মী ও নিয়োগদাতা—দুই পক্ষের জন্যই উপকারী এবং ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সহায়ক।

আইন মেনে চলা ও নিয়ন্ত্রণ
অভিবাসনবিরোধীদের অন্যতম ভয়—অতিথি শ্রমিকরা ভিসার মেয়াদ শেষে গা ঢাকা দিতে পারে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে মৌসুমি কৃষিশ্রমিকরা অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় অনেক কম হারে ভিসা অতিক্রম করেন। কারণ, প্রথমত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয় যদি শ্রমিক পালিয়ে যায়; দ্বিতীয়ত সেখানে আশ্রয় প্রার্থনার সুযোগ না থাকায় শ্রমিকদের থেকে যাওয়ার প্রবণতা কমে।
স্থায়ী অভিবাসনের বিকল্প নয়
অবশ্য অতিথি শ্রমিক প্রকল্পের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি ভিসায় উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ সীমিত, ফলে উদ্ভাবন বাধাগ্রস্ত হয়। দক্ষ শ্রমিকরা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে বেশি অবদান রাখে—তাদের আকর্ষণ করা উচিত, নিরুৎসাহিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে অতিরিক্ত ভিসা ফি আরোপ এই সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে।

ভারসাম্যের পথ
স্থায়ী অভিবাসনে ভোটারদের অনীহার সময় অতিথি শ্রমিক প্রকল্প এক কার্যকর বিকল্প হতে পারে। সঠিকভাবে পরিচালিত প্রকল্পগুলো শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ, আয়োজক দেশের জন্য লাভজনক এবং অভিবাসনবিরোধী মনোভাব ও উদারনীতির মধ্যে এক বাস্তবসম্মত ভারসাম্য সৃষ্টি করতে পারে।
#অভিবাসন #অর্থনীতি #শ্রমবাজার #দক্ষশ্রমিক #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















