এক সময়ের ব্যস্ত বাণিজ্যকেন্দ্র এখন পরিত্যক্ত
চুয়াডাঙ্গার দর্শনা রেলওয়ে স্টেশন, যা এক সময় সীমান্ত বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল, এখন নীরব ও জনশূন্য। ভারত থেকে পণ্য আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজস্ব আদায়ে বড় ধাক্কা লেগেছে, পাশাপাশি বেকার হয়ে পড়েছেন হাজারো শ্রমিক ও পরিবহনকর্মী।
রাজস্বে ৬০ শতাংশ পতন
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে দর্শনা স্টেশন থেকে রাজস্ব আয় হয়েছিল ২৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে সেই আয় নেমে এসেছে মাত্র ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকায়— যা প্রায় ৬০ শতাংশ হ্রাস।
ট্রেন বন্ধ, শ্রমিক বেকার
অল্প কিছুদিন আগেও ভুট্টা, পাথর, পেঁয়াজ, চায়না ক্লে, জিপসাম ও সয়াবিন মিলে বোঝাই ট্রেন প্রতিদিন স্টেশনে প্রবেশ করত। এতে ব্যস্ত থাকত শত শত শ্রমিক, ট্রাকচালক ও ক্লিয়ারিং এজেন্ট।
কিন্তু এখন দৃশ্য একেবারে ভিন্ন— কদাচিৎ কয়েকটি ওয়াগনে ফ্লাই অ্যাশ আসে, সেটিও অনেক সময় অন্যত্র খালাস হয়।
আমদানি হ্রাসের কারণ
দর্শনা ছিল আমদানিকারকদের অন্যতম পছন্দের প্রবেশপথ, কারণ এখানে খরচ তুলনামূলক কম ও লজিস্টিক সহায়তা বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমানে এলসি (Letter of Credit) জটিলতা, ডলার সংকট এবং সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় আমদানি প্রায় স্থবির হয়ে গেছে।
গত অর্থবছরে ভারত থেকে ৯,৭৪৯টি মালবাহী ওয়াগনে ৫,৭৬,৫৫৯ মেট্রিক টন পণ্য এসেছিল। চলতি বছরে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪,৪৮৬ ওয়াগনে ২,৫২,১০১ টন— আগের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
জীবিকা সংকটে শ্রমজীবী মানুষ
এই ধীরগতির বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্টেশন-নির্ভর শ্রমজীবী মানুষরা। শত শত ট্রাকচালক ও শ্রমিক এখন কর্মহীন। কেউ পেশা বদলেছেন, কেউ আবার অন্য জেলায় কাজের খোঁজে গেছেন।
ইয়ার্ড শ্রমিক সাইদুল ইসলাম বলেন, “এখন মনে হয় করোনার সময়ের মতো অবস্থা। সারাদিন বসে থাকি, কোনো ট্রেন আসে না।”
ট্রাকচালক টিটু মিয়া বলেন, “আগে দিনে দুই-তিনটা ট্রিপ দিতাম, এখন তিন দিনেও একটা ট্রিপ হয় না।”

যানবাহন মালিকদের লোকসান
ট্রাক মালিকরা জানান, তাদের গাড়িগুলো সপ্তাহের পর সপ্তাহ অব্যবহৃত পড়ে থাকে। এতে আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। “প্রতি মাসেই আমরা লোকসান দিচ্ছি। অনেক ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, কোনো কাজ নেই,” বলেন এক মালিক।
এলসি জটিলতায় ব্যবসা স্থবির
কাস্টমস এজেন্ট ও ব্যবসায়ীরা জানান, এলসি খোলার নিয়ম কঠিন হয়ে গেছে। এখন ব্যাংকগুলো সম্পূর্ণ নগদ অর্থ জমা ছাড়া এলসি অনুমোদন দেয় না, যা আগে আংশিক অর্থ জমা দিলেও চলত।
দর্শনা সিএন্ডএফ এজেন্ট রফিকুল ইসলাম বলেন, “এলসি প্রক্রিয়া সহজ হলে ব্যবসা আবার স্বাভাবিক হবে।”
ব্যবসায়ী রানা খান বলেন, “আমাদের পুঁজি, ট্রাক আর কর্মীরা সবাই অব্যবহৃত। আমদানি বন্ধ থাকায় আমরা পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছি।”
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় আবারও মন্দা
অনেক শ্রমিক জানান, করোনার পর স্টেশনটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় আবারও মন্দা দেখা দিয়েছে। এক শ্রমিক বলেন, “আমরা শুধু স্থিতিশীলতা চাই, যাতে আবার কাজ শুরু করতে পারি।”
প্রশাসনের আশাবাদ
দর্শনা আন্তর্জাতিক রেলওয়ে স্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট মির্জা কামরুল হক বলেন, “এ বছর রাজস্ব ব্যাপক হারে কমেছে, কারণ ভারত থেকে আমদানি হ্রাস পেয়েছে। তবে রাজনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরলে আমদানি আবার বাড়বে বলে আমরা আশাবাদী।”
ব্যবসায়ী মহলের মত
চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি জানায়, এলসি জটিলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এই স্থবিরতার মূল কারণ। চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি শহরিন হক মালিক বলেন, “যতদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়, ততদিন এই ইয়ার্ডে প্রাণ ফিরবে না, ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে থাকবেন।”
একসময়ের প্রাণবন্ত স্টেশন এখন নিস্তব্ধ
মির্জা কামরুল হক বলেন, “যে দর্শনা একসময় মালবাহী ট্রেনের শব্দ ও শ্রমিকদের কর্মচাঞ্চল্যে মুখর থাকত, আজ সেখানে নেমে এসেছে নীরবতা। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কত দ্রুত মানুষের জীবিকা বিপর্যস্ত করতে পারে— দর্শনা তার জীবন্ত উদাহরণ।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















