দিনাজপুরের পার্বতীপুরে কয়লাভিত্তিক বড়পুকুরিয়া ৫২৫ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সাত দিনেও চালু করা যায়নি। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এতে উত্তরাঞ্চলের আট জেলার বাসিন্দারা পড়েছেন তীব্র লোডশেডিং ও ভোল্টেজ সমস্যায়।
ত্রুটিজনিত স্থবিরতা
গত ১৬ অক্টোবর সকালে কেন্দ্রটির ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তৃতীয় ইউনিটে গর্ভনর ভালভ স্টিম সেন্সরের চারটি টারবাইন নষ্ট হয়ে যায়। এরপর ১৯ অক্টোবর রাত সাড়ে ৮টার দিকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয় ১২৫ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিটও। এর ফলে কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় ইউনিট ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে সংস্কারকাজের জন্য বন্ধ রয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর পার হলেও এখনও সেটি চালু করা সম্ভব হয়নি। প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মেরামতের জন্য আগের চেয়ে বেশি অর্থ দাবি করায় সিদ্ধান্ত আটকে আছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
উৎপাদন ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা
২০০৬ সালে পার্বতীপুরের হামিদপুর ইউনিয়নে কয়লাভিত্তিক এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়। প্রথমে দুটি ইউনিটের মাধ্যমে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়, পরবর্তীতে ২০১৭ সালে তৃতীয় ইউনিট যুক্ত হয়ে মোট উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়ায় ৫২৫ মেগাওয়াটে।
তবে যান্ত্রিক ত্রুটি ও সংস্কারজনিত কারণে কখনও তিনটি ইউনিট একসঙ্গে চালানো সম্ভব হয়নি।
সর্বশেষ বন্ধ হওয়ার আগে প্রথম ইউনিট থেকে ৫০-৫৫ মেগাওয়াট এবং তৃতীয় ইউনিট থেকে ১৬০-১৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হতো। বর্তমানে তিনটি ইউনিটই অচল।
উত্তরে তীব্র লোডশেডিং
কেন্দ্রটি বন্ধ থাকায় জাতীয় গ্রিড থেকেও উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে গেছে। পার্বতীপুরসহ দিনাজপুর, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র লোডশেডিং। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কয়েক দফায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে।
চলমান তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায় এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। অনেক জায়গায় পানির সংকট ও কলকারখানার কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটছে।
কৃষি ও শিল্পে প্রভাব
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, সামনে শীত মৌসুমে বোরো ও শীতকালীন সবজি চাষে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ না পেলে সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এতে উৎপাদন কমবে ও খরচ বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে বাজারমূল্যেও।
চালকল মালিকরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, বিদ্যুতের ঘাটতি অব্যাহত থাকলে উৎপাদনে প্রভাব পড়বে, ব্যবসায়ীরা ধান কেনায় আগ্রহ হারাবেন, এবং কৃষকরা ন্যায্য দাম পাবেন না।
কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা
বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক জানিয়েছেন, প্রথম ইউনিট চালু করতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে। তবে তৃতীয় ইউনিট চালু করতে আরও সময় প্রয়োজন, কারণ এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
চীনের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হারবিন ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, তারা ইউনিট ঠান্ডা হওয়ার পর মেরামতকাজ শুরু করবে।
তিনি আরও জানান, ২০২০ সাল থেকে বন্ধ দ্বিতীয় ইউনিটের ব্যাপারে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে এবং প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সেটি মেরামতের জন্য ২৩ মিলিয়ন ডলার দাবি করছে।
স্থানীয় ক্ষোভ
দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক ও মিলমালিক সমিতির সহসভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন,
“একটি ইউনিট পাঁচ বছর ধরে বন্ধ, আর বাকি দুটি কখনও চালু কখনও বন্ধ থাকে। কৃষি ও স্থানীয় অর্থনীতির জন্য এই কেন্দ্র অপরিহার্য। তাই দ্রুতই তিনটি ইউনিট চালু করা জরুরি।”
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন,
“ভোর বা রাত—যে সময়ই হোক, বিদ্যুৎ চলে যায়। দীর্ঘ সময় পর এলেও ভোল্টেজ এত কম থাকে যে কিছুই চালানো যায় না। এই অবস্থায় জীবনযাপনই কঠিন হয়ে পড়েছে।”
কয়লা সরবরাহ ও গ্রিড পরিস্থিতি
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কোল ইয়ার্ডে বর্তমানে প্রায় চার লাখ ৬০ হাজার টন কয়লা মজুত আছে। তবে নেসকো পার্বতীপুর কার্যালয় জানিয়েছে, শহরের বিদ্যুৎ চাহিদা ছয় থেকে সাত মেগাওয়াট হলেও সরবরাহ মিলছে মাত্র তিন থেকে চার মেগাওয়াট। ফলে প্রায় ২০ হাজার গ্রাহক নিয়মিত লোডশেডিংয়ের শিকার হচ্ছেন।
পুনরাবৃত্ত যান্ত্রিক ত্রুটি
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি, জুলাই ও অক্টোবর মাসে একাধিকবার ইউনিটগুলো বন্ধ হয়েছে। প্রতিবারই প্রস্তুতকারী কোম্পানির সহায়তায় মেরামত শেষে পুনরায় চালু করা হলেও, কয়েক সপ্তাহ পর আবার যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ এসব ত্রুটিকে “প্রযুক্তিগত স্বাভাবিকতা” হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও, স্থানীয়রা বলছেন, এটি অব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতির ফল।
#লোডশেডিং #বড়পুকুরিয়া_তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র #দিনাজপুর #বিদ্যুৎ_সংকট #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















