০৮:১০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫
এনসিপি নেতাকে গুলি: নারী সঙ্গী পলাতক, ফ্ল্যাট থেকে মাদকসংশ্লিষ্ট আলামত উদ্ধার তারেক রহমানের দেশে ফেরা সামনে রেখে শঙ্কার কথা জানালেন মির্জা আব্বাস গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোটের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার ওসমান হাদির বোন পাচ্ছেন অস্ত্রের লাইসেন্স ও গানম্যান তিন যুগ, তিন ফাইনাল, একই বাধা ভারত—সারফরাজের নামেই আবার পাকিস্তানের জয়গাথা সোশ্যাল মিডিয়া যাচাইয়ে জট, দেশে ফেরা থামাচ্ছেন ভারতীয় কর্মীরা অ্যাশেজ ধরে রাখলো অস্ট্রেলিয়া মাত্র এগারো দিনে, কথিত দুর্বল দলেই ইংল্যান্ডকে ধস গোপালগঞ্জে শেখ হাসিনার আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী এবার বিএনপি-জামায়াত!  হত্যার ঝুঁকিতে পঞ্চাশজন, গানম্যান পেয়েছেন বিশজন ২০২৫ সালের তারকা: সিনেমার ভবিষ্যৎ আর নতুন তারকাখ্যাতির অর্থ

চীনে কীভাবে চড়ুই পাখি ধ্বংসের প্রচেষ্টা ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু ডেকে এনেছিল

শিল্পায়নের স্বপ্নে মৃত্যুমিছিল

১৯৫৮ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে চীন শুরু করে ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’—এক বিশাল পরিকল্পনা, যার লক্ষ্য ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে দ্রুত একটি আধুনিক শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তর। কিন্তু এই প্রচেষ্টা পরিণত হয় ভয়াবহ বিপর্যয়ে। অকার্যকর শিল্পায়ন ও কৃষিক্ষেত্রে জোরপূর্বক সমবায়ীকরণ চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে, যেখানে ১ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে বলে ধারণা করা হয়।

‘চার কীট’ অভিযান ও চড়ুই নিধনের উন্মাদনা

গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের অংশ হিসেবে মাও ঘোষণা করেন “চার কীট অভিযান”—যার লক্ষ্য ছিল মাছি, মশা, ইঁদুর ও চড়ুই পাখি নির্মূল। প্রথম তিনটি লক্ষ্য নিয়ে তেমন বিতর্ক না থাকলেও, চড়ুই পাখিকে শত্রু ঘোষণা করা হয় কৃষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে; তারা বলেছিল, চড়ুই শস্য খেয়ে ফসলের ক্ষতি করে।

বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী ঝু শি সতর্ক করে দেন যে, ১৮শ শতকের প্রুশিয়ার এক চড়ুই নিধন অভিযানের পর সেখানে ভয়াবহ কীটপতঙ্গের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। কিন্তু মাও এসব সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেন। ফলে গোটা চীনজুড়ে এক উন্মত্ত অভিযান শুরু হয়—চড়ুইয়ের বাসা ধ্বংস, হাঁড়ি-পাতিল বাজিয়ে পাখিদের উড়িয়ে দেওয়া, আর সর্বত্র নিধনের উৎসব। দুই বছরের মধ্যেই আনুমানিক ২০০ কোটি চড়ুই পাখি হত্যা করা হয়।

China: Myths Surrounding the Anti-Sparrow Campaign (1958) – SANGHA KOMMUNE  (SSR)

প্রকৃতির প্রতিশোধ: পোকামাকড়ের দাপট ও খাদ্যসংকট

চড়ুই পাখি যে শস্য খায় তা সত্য, তবে গ্রীষ্মকালে তাদের প্রধান খাদ্য ছিল ফসলনাশক পোকারা—যেমন পঙ্গপাল ও ধানকাটা পোকার মতো ক্ষতিকর প্রাণী। চড়ুই নিধনের পর এসব কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃদ্ধি পায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ আক্রমণ চালায়, যা কৃষি উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

অতিরিক্ত ক্ষতি হয় কেন্দ্রীয় সরকারের শস্য পুনর্বণ্টন নীতির কারণে। সরকার বিশ্বাস করেছিল, চড়ুই মারা গেলে ফসল বাড়বে—তাই যেসব অঞ্চল বেশি চড়ুই মেরেছে, সেখান থেকে বেশি পরিমাণে শস্য সংগ্রহ করা হয়। এতে আনহুই ও গুইঝৌসহ কয়েকটি প্রদেশে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দেয়।

গবেষণায় প্রকাশ: এক বিপর্যয়কর গণহত্যার পরিসংখ্যান

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ইয়াল ফ্র্যাঙ্ক ও তাঁর সহকর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকনমিক রিসার্চের একটি গবেষণাপত্রে এই অভিযানের ভয়াবহ প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ু তথ্য—যেমন তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত—ব্যবহার করে হিসাব করেন কোন অঞ্চলে চড়ুই পাখির বসবাসের অনুকূল পরিবেশ ছিল এবং সেখানকার ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কত।

Rare Images of the Four Pests Campaign to Wipe Out the Sparrow

তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেখানে চড়ুইয়ের সংখ্যা আগে বেশি ছিল, সেখানে ফসল উৎপাদন ও জন্মহার কমে যায় এবং মৃত্যুহার বেড়ে যায়। গবেষকরা অনুমান করেছেন, চড়ুই নিধন অভিযান একাই দুর্ভিক্ষকালীন মোট শস্য উৎপাদন হ্রাসের প্রায় ২০ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল। এই ক্ষতির সরাসরি ফলে প্রায় ২০ লাখ মানুষ মারা যায়, আর খাদ্যসংকটে আরও প্রায় ৪ লাখ জন্ম বন্ধ হয়ে যায়।

দেরিতে হলেও উপলব্ধি

১৯৬০ সালে যখন পার্টির শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে যায় এই বিপর্যয়ের খবর, তখন মাও চড়ুইকে “চার কীট” তালিকা থেকে বাদ দেন এবং তার পরিবর্তে বিছানার পোকাকে যুক্ত করেন। কিন্তু ততদিনে চড়ুই প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার চড়ুই আমদানি করে চীন।

১৯৮০-এর দশকে চীন সমাজতন্ত্রের পথ পরিত্যাগ করে বাজারভিত্তিক সংস্কারে এগোয়, এবং এরপর আর কখনো তেমন দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়নি। ধীরে ধীরে চড়ুইয়ের সংখ্যা পুনরুদ্ধার হয়, আর আজ আবারও তারা চীনের শহর ও গ্রামজুড়ে মুক্তভাবে উড়ে বেড়ায়—ইতিহাসের এক করুণ শিক্ষা হয়ে।

 

#চীন #মাওসেতুং #দুর্ভিক্ষ #চড়ুইঅভিযান #ইতিহাস

জনপ্রিয় সংবাদ

এনসিপি নেতাকে গুলি: নারী সঙ্গী পলাতক, ফ্ল্যাট থেকে মাদকসংশ্লিষ্ট আলামত উদ্ধার

চীনে কীভাবে চড়ুই পাখি ধ্বংসের প্রচেষ্টা ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু ডেকে এনেছিল

১২:২২:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫

শিল্পায়নের স্বপ্নে মৃত্যুমিছিল

১৯৫৮ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে চীন শুরু করে ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’—এক বিশাল পরিকল্পনা, যার লক্ষ্য ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে দ্রুত একটি আধুনিক শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তর। কিন্তু এই প্রচেষ্টা পরিণত হয় ভয়াবহ বিপর্যয়ে। অকার্যকর শিল্পায়ন ও কৃষিক্ষেত্রে জোরপূর্বক সমবায়ীকরণ চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে, যেখানে ১ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে বলে ধারণা করা হয়।

‘চার কীট’ অভিযান ও চড়ুই নিধনের উন্মাদনা

গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের অংশ হিসেবে মাও ঘোষণা করেন “চার কীট অভিযান”—যার লক্ষ্য ছিল মাছি, মশা, ইঁদুর ও চড়ুই পাখি নির্মূল। প্রথম তিনটি লক্ষ্য নিয়ে তেমন বিতর্ক না থাকলেও, চড়ুই পাখিকে শত্রু ঘোষণা করা হয় কৃষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে; তারা বলেছিল, চড়ুই শস্য খেয়ে ফসলের ক্ষতি করে।

বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী ঝু শি সতর্ক করে দেন যে, ১৮শ শতকের প্রুশিয়ার এক চড়ুই নিধন অভিযানের পর সেখানে ভয়াবহ কীটপতঙ্গের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। কিন্তু মাও এসব সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেন। ফলে গোটা চীনজুড়ে এক উন্মত্ত অভিযান শুরু হয়—চড়ুইয়ের বাসা ধ্বংস, হাঁড়ি-পাতিল বাজিয়ে পাখিদের উড়িয়ে দেওয়া, আর সর্বত্র নিধনের উৎসব। দুই বছরের মধ্যেই আনুমানিক ২০০ কোটি চড়ুই পাখি হত্যা করা হয়।

China: Myths Surrounding the Anti-Sparrow Campaign (1958) – SANGHA KOMMUNE  (SSR)

প্রকৃতির প্রতিশোধ: পোকামাকড়ের দাপট ও খাদ্যসংকট

চড়ুই পাখি যে শস্য খায় তা সত্য, তবে গ্রীষ্মকালে তাদের প্রধান খাদ্য ছিল ফসলনাশক পোকারা—যেমন পঙ্গপাল ও ধানকাটা পোকার মতো ক্ষতিকর প্রাণী। চড়ুই নিধনের পর এসব কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃদ্ধি পায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ আক্রমণ চালায়, যা কৃষি উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

অতিরিক্ত ক্ষতি হয় কেন্দ্রীয় সরকারের শস্য পুনর্বণ্টন নীতির কারণে। সরকার বিশ্বাস করেছিল, চড়ুই মারা গেলে ফসল বাড়বে—তাই যেসব অঞ্চল বেশি চড়ুই মেরেছে, সেখান থেকে বেশি পরিমাণে শস্য সংগ্রহ করা হয়। এতে আনহুই ও গুইঝৌসহ কয়েকটি প্রদেশে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দেয়।

গবেষণায় প্রকাশ: এক বিপর্যয়কর গণহত্যার পরিসংখ্যান

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অর্থনীতিবিদ ইয়াল ফ্র্যাঙ্ক ও তাঁর সহকর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকনমিক রিসার্চের একটি গবেষণাপত্রে এই অভিযানের ভয়াবহ প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ু তথ্য—যেমন তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত—ব্যবহার করে হিসাব করেন কোন অঞ্চলে চড়ুই পাখির বসবাসের অনুকূল পরিবেশ ছিল এবং সেখানকার ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কত।

Rare Images of the Four Pests Campaign to Wipe Out the Sparrow

তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেখানে চড়ুইয়ের সংখ্যা আগে বেশি ছিল, সেখানে ফসল উৎপাদন ও জন্মহার কমে যায় এবং মৃত্যুহার বেড়ে যায়। গবেষকরা অনুমান করেছেন, চড়ুই নিধন অভিযান একাই দুর্ভিক্ষকালীন মোট শস্য উৎপাদন হ্রাসের প্রায় ২০ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল। এই ক্ষতির সরাসরি ফলে প্রায় ২০ লাখ মানুষ মারা যায়, আর খাদ্যসংকটে আরও প্রায় ৪ লাখ জন্ম বন্ধ হয়ে যায়।

দেরিতে হলেও উপলব্ধি

১৯৬০ সালে যখন পার্টির শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে যায় এই বিপর্যয়ের খবর, তখন মাও চড়ুইকে “চার কীট” তালিকা থেকে বাদ দেন এবং তার পরিবর্তে বিছানার পোকাকে যুক্ত করেন। কিন্তু ততদিনে চড়ুই প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার চড়ুই আমদানি করে চীন।

১৯৮০-এর দশকে চীন সমাজতন্ত্রের পথ পরিত্যাগ করে বাজারভিত্তিক সংস্কারে এগোয়, এবং এরপর আর কখনো তেমন দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়নি। ধীরে ধীরে চড়ুইয়ের সংখ্যা পুনরুদ্ধার হয়, আর আজ আবারও তারা চীনের শহর ও গ্রামজুড়ে মুক্তভাবে উড়ে বেড়ায়—ইতিহাসের এক করুণ শিক্ষা হয়ে।

 

#চীন #মাওসেতুং #দুর্ভিক্ষ #চড়ুইঅভিযান #ইতিহাস