ডিসেম্বর এলেই গ্রামের বদলে যাওয়া সকাল
বাংলাদেশের গ্রামীণ শিশুদের কাছে ডিসেম্বর শুধু বছরের সমাপ্তি নয়; এটি ছিল নির্মল আনন্দের এক মৌসুমের শুরু। পুরো মাসজুড়ে ছুটির মুক্ত অনুভূতি—যা শীতের আবহাওয়ায় আরও প্রবল হয়ে উঠত—গ্রামময় ছড়িয়ে দিত এক ধরনের উচ্ছ্বাস ও আপনতা। ঘন কুয়াশা, কাঁপানো শীত আর পাশে-বাসার সবার সঙ্গে মিশে খেলার সঙ্গ—সব মিলেই তৈরি হতো শৈশবের সেই সোনালি দিনগুলো।
ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকেই গ্রামের দৃশ্যে শুরু হতো বার্ষিক রূপান্তর। ভোরের দিকে নেমে আসা শীতল কুয়াশা দিনটিকে দিত প্রশান্ত এক সুর। শীতের প্রথম সংকেতের সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ত পিঠার মনভোলানো সুগন্ধ; বাঙালি রান্নাঘরের এই অনুষঙ্গ পুরো পাড়ায় ছড়িয়ে দিত এক দৃশ্যমান উষ্ণতা ও সমবায়ের অনুভূতি।
মহা মিলন: আপনজনের ফেরা, খেলার সাথী বাড়া
সারা বছর যাদের নিয়ে খেলা—সেই মূল দলের বাইরে ডিসেম্বর আনত বাড়তি খুশির ঢেউ। মাসের শুরুতে স্কুলের পরীক্ষা শেষ হতেই শহর ও উপজেলা থেকে পড়তে যাওয়া আত্মীয়স্বজন, কাজিন-বন্ধুরা ফিরে আসত গ্রামে। নিস্তব্ধ গলি-ঘুঁজিগুলো হয়ে উঠত কোলাহলমুখর খেলার মাঠ। একেকটি বাড়িতে হঠাৎ করেই দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে যেত খেলার সাথী। নতুন মুখ, নতুন উচ্ছ্বাসে উৎসবের আমেজ কয়েক গুণ বেড়ে যেত; সাধারণ খেলাও হয়ে উঠত দ্বিগুণ মজার।

শীতের ছুটিতে জনপ্রিয় গ্রামীণ খেলাগুলো
দীর্ঘ ছুটির দিনগুলো যেন প্রসারিত হতেই থাকত—খেলাধুলার জন্য একেবারে উপযুক্ত। আন্তর্জাতিক খেলার পাশাপাশি ফিরে আসত সেই দেশি ঐতিহ্য, যেগুলো খেলতে লাগে বড় দল আর খোলা জায়গা। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের মাঠে ফুটবল-ক্রিকেট যেমন দাপট দেখাত, তেমনি খেলার হৃদয় দখল করে থাকত দেশি-ট্র্যাডিশনাল খেলাগুলো।
সাতচারা
দুই দলে সমান খেলোয়াড় নিয়ে খেলা হয়। সাতটি মাটির খণ্ড বা চাপ্টা পাথর একটার ওপর আরেকটা রেখে স্তূপ তৈরি করা হয়। আক্রমণকারী দল বল ছুড়ে স্তূপটি ফেলে দেয়; এরপর প্রতিপক্ষের ছোড়া বলে আঘাত না খেয়ে আবার সেই স্তূপ গড়া—এটাই ‘সাতচারা’র মূল কৌশল। বল গায়ে লাগলেই খেলোয়াড় আউট। প্রতিপক্ষকে ছুঁয়ে নিজেকে সেফ করে নেওয়ারও নিয়ম রয়েছে।
কুটকুট (কিটকিট/এক্কা-ডোক্কা)
মাটিতে আঁকা খোপের (গ্রিড) ওপর অন্তত দু’জন মিলে খেলা হয়। খেলোয়াড় ছোট একটি পাথর নির্দিষ্ট খোপে ফেলে এক পায়ে লাফিয়ে খোপগুলো পার হয় এবং পাথরটি পা দিয়ে ঠেলে বের করে। পাথর লাইন ছুঁলে, ছন্দ নষ্ট হলে বা দুই পা পড়লে সে রাউন্ড শেষ। যে আগে সব খোপ সফলভাবে পার হয়, সে-ই জয়ী।
কানামাছি
ছেলে-মেয়ে সবার প্রিয় এই খেলায় একজনের চোখ বেঁধে ‘কানামাছি’ বানানো হয়। অন্যরা তাকে ঘিরে ছড়াগান বলতে বলতে ঘোরে—“কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ।” চোখ বাঁধা খেলোয়াড় কাউকে ছুঁতে পারলেই পরের রাউন্ডে সে হয় নতুন ‘কানামাছি’। কখনো-সখনো মজার ছড়া—“আঁধা গন্ধা ভাই, আমার দোষ নাই”—খেলার আমেজ বাড়ায়।

বউচি
দম ধরে খেলা দলীয় ট্যাগ-গেম। একদল ‘বউ’ বা ‘বুড়ি’কে নিজেদের নিরাপদ এলাকায় আনার চেষ্টায় থাকে; অন্য দল তাকে রক্ষা করে। যে খেলোয়াড় দম ছেড়ে দেয় বা ধরা পড়ে, সে আউট। সহখেলোয়াড়রা পথ পরিষ্কার করে দিলে ‘বউ’ সেফ জোনে পৌঁছালেই ধাওয়াকারী দল জেতে।
গুলি-ডান্ডা
ক্রিকেটের প্রাচীন ধাঁচ বলা হয়। লম্বা কাঠি (ডান্ডা) দিয়ে ছোট শলা (গুলি) ওপরের দিকে ছুড়ে দূরে পাঠানো হয়। দূরত্ব মেপে রান ধরা হয়। প্রতিপক্ষ বাতাসে গুলি ধরতে পারলে সরাসরি আউট। হাত-চোখের সমন্বয়, মনোযোগ ও প্রতিযোগিতাবোধ বাড়ায় এ খেলা।
এলাতিং-বেলাতিং
দুই দল হাত ধরে লাইন বানিয়ে ছড়াগান বলতে বলতে একে অপরের দিকে এগোয়। ছড়া শেষ হতেই যে দল ছড়া বলেছে, তারা প্রতিপক্ষের লাইন থেকে একজনকে টেনে নিজেদের লাইনে আনতে পারলে তাৎক্ষণিক জয় পায়।
ফুল টোকা
দুই দল মুখোমুখি লাইনে দাঁড়িয়ে খেলে। পালা করে একজনের চোখ বাঁধা হয়; কে কপালে আলতো ছুঁল, সেটা অনুমান করে বলতে হয়। সঠিক হলে খেলোয়াড় সামনে এক ধাপ এগোয়; ভুল হলে প্রতিপক্ষ এগোয়। যে দল আগে সম্পূর্ণভাবে বিভাজনরেখা পার হতে পারে, তারাই জেতে।
দাড়িয়াবান্ধা
চৌকো-চিহ্নিত গ্রিডে দুই দল নামে। এক দল লাইনে দাঁড়িয়ে পাহারা দেয়; অন্য দল নিজের ‘ঘর’ থেকে সব খোপ পার হয়ে ফিরে আসতে চায়। ট্যাগ হয়ে গেলে রাউন্ড হার; সফলভাবে সব খোপ পার হয়ে ফিরে এলে পয়েন্ট—তারপর ভূমিকা বদল।

গোল্লাছুট
বড় বৃত্তের মাঝে একটি খুঁটি গেড়ে খেলা হয়। ‘রাজার দল’ হাত ধরে খুঁটিকে ঘিরে ঘোরে। ইশারায় শৃঙ্খল ভেঙে খেলোয়াড়রা বৃত্তের বাইরে ছুটে যায়; প্রতিপক্ষ ট্যাগ করলে ধরা। লোককথায় এ খেলা কৃষিশ্রমিক/দাসদের পালানোর প্রতীকী ইঙ্গিত বহন করে বলে ধারণা।
স্মৃতির ছবি আর আজকের বাস্তবতা
শীতের তীক্ষ্ণ হাওয়া, রান্নাঘরভরা পিঠার মিষ্টি গন্ধ, উঠোনজুড়ে শিশুদের কোলাহল—এই স্মৃতি সত্যিই জীবন্ত। কিন্তু আজকের শিশুদের বেড়ে ওঠায় এই ঐতিহ্য ক্রমেই অনুপস্থিত; প্রাণবন্ত আউটডোর খেলাগুলো সরে যাচ্ছে মোবাইল ও স্ক্রিনের দিকে।
এই পরিচয় আমাদের হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। প্রয়োজন পরবর্তী প্রজন্মকে একসঙ্গে বাইরে খেলার সত্যিকারের আনন্দটা অনুভব করানো। কমিউনিটি, স্কুল, পরিবার—সবাইকে হাত মিলিয়ে দেশীয় খেলাকে বাঁচাতে ক্লাব-কার্যক্রম, ছুটির ক্যাম্প ও নিয়মিত আয়োজন গড়ে তুলতে হবে। তবেই আবার ফিরতে পারে সেই সোনালি ডিসেম্বর—ভাগাভাগি আনন্দ আর সত্যিকারের মিলনমেলার দিনগুলো।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















