চিকিৎসার ইতিহাসে এক রূপান্তর
১৯৯০-এর দশকে, যখন ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গে অনকোলজিস্ট অ্যাডাম ব্রুফস্কি তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন, তখন স্তন ক্যান্সার চিকিৎসা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। সেই সময় প্রধান ভরসা ছিল মাত্র একটি ওষুধ—টামোক্সিফেন। কিন্তু আজ, তিন দশক পরে, চিকিৎসা পদ্ধতি ও প্রযুক্তিতে এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। ব্রুফস্কির ভাষায়, “এখনকার চিকিৎসা আগের তুলনায় কতটা এগিয়েছে, তা সত্যিই নাটকীয়।”
এক সাম্প্রতিক গবেষণা জানায়, বর্তমানে প্রাথমিক স্তরের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীরা ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় পাঁচ বছরের মধ্যে মৃত্যুর ঝুঁকি দুই-তৃতীয়াংশ কম।
‘কমেই বেশি’—চিকিৎসার নতুন দর্শন
অ্যালেগেনি হেলথ নেটওয়ার্কের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্তন ক্যান্সার ক্লিনিকের, প্রধান চিকিৎসক ড. জ্যানেট গোমেজ বলেন, “আগে আমরা ভাবতাম যত বেশি চিকিৎসা, তত ভালো ফল। এখন বুঝেছি, অপ্রয়োজনীয় আক্রমণ কমিয়েও কার্যকরভাবে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করা যায়।”
এই ধারণার সূচনা হয়েছিল পিটসবার্গেই, ১৯৭০-এর দশকে, যখন গবেষক বার্নি ফিশার প্রমাণ করেছিলেন — সাধারণ মেসটেকটমি (স্তন অপসারণ) অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ‘র্যাডিকাল মেসটেকটমি’র মতোই কার্যকর।

আজ সেই নীতি আরও পরিশীলিত। যেমন—বগলের সব লিম্ফ নোড না কেটে কেবল ‘সেন্টিনেল’ নোড পরীক্ষা করাই যথেষ্ট, যা রোগীর লিম্ফিডেমা (স্ফীততা) ঝুঁকি কমায়।
আধুনিক প্রযুক্তি ও কম জটিল অস্ত্রোপচার
নতুন রঞ্জক-প্রযুক্তি এখন এমন রোগীদের লিম্ফ নোড সম্পূর্ণ অক্ষত রাখার সুযোগ দিচ্ছে, যাদের ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে। অনেক রোগী আবার অস্ত্রোপচারের আগে কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি বা হরমোন থেরাপি বেছে নিচ্ছেন, যাতে টিউমারের আকার ছোট করে পরবর্তীতে শুধু আংশিক অস্ত্রোপচার (লাম্পেক্টমি) করা যায়।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানোর গবেষণা
গত এক দশকে গবেষণার বড় লক্ষ্য হয়ে উঠেছে চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানো। ড. গোমেজ বলেন, ‘আমাদের রোগীরা এখন দীর্ঘ জীবন পাচ্ছেন। তাই চিকিৎসাকে আরও সহনীয় করে তোলা জরুরি।’
জিনোমিক পরীক্ষা এখন ৭০টিরও বেশি জিন বিশ্লেষণ করে বোঝে কোন রোগীর ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি দরকার এবং কোন ক্ষেত্রে তা অপ্রয়োজনীয়। ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ বছরোর্ধ্ব নারীদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সার্জারি বা রেডিয়েশন বরং ক্ষতি করতে পারে।
লক্ষ্যভিত্তিক ওষুধে চিকিৎসার বিপ্লব
ব্রুফস্কি বলেন, “আগে আমাদের হাতে ছিল কেবল টামোক্সিফেন, কিন্তু এখন রোগীর জিনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওষুধ ব্যবহার করা সম্ভব।”

১৯৯০-এর দশকে HER2-প্রোটিন-অতিরিক্ত রোগীদের জন্য তৈরি হয় ‘হারসেপ্টিন’ — একটি অ্যান্টিবডি যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে। এর ফলে ক্যান্সার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি অর্ধেকে নেমে আসে, আর মৃত্যুহার কমে ত্রিশ শতাংশ পর্যন্ত।
এছাড়া ‘CDK4/6 ইনহিবিটার’ নামের নতুন ওষুধ উন্নত স্তরের হরমোন-নির্ভর স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসায় জীবনকাল বাড়িয়েছে বহুগুণ।
দ্রুত শনাক্তকরণে প্রযুক্তির ভূমিকা
বর্তমানে ডিজিটাল ম্যামোগ্রাম ত্রিমাত্রিক (৩ডি) চিত্রে স্তন টিস্যু বিশ্লেষণ করতে পারে, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে দ্রুত রিপোর্ট বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ড. গোমেজের মতে, “আমরা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে গুটি স্পর্শযোগ্য হওয়ার আগেই ম্যামোগ্রামে ক্যান্সার ধরা পড়ে।”
সেন্ট ক্লেয়ার মেডিকেল গ্রুপের সারওয়াত আহমদ জানান, যাদের স্তন টিস্যু ঘন, তাঁদের জন্য ম্যামোগ্রামের সঙ্গে এমআরআই করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, কারণ ঘন টিস্যুতে ক্যান্সার শনাক্ত করা তুলনামূলক কঠিন।
ভবিষ্যতের দিগন্ত: টিকা ও জিন-গবেষণা
স্তন ক্যান্সার চিকিৎসার পরবর্তী অধ্যায় খুলে দিচ্ছে নতুন ভ্যাকসিন পরীক্ষা ও জেনেটিক স্ক্রিনিং। পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের নেতৃত্বে একটি ভ্যাকসিন গবেষণা ইতিমধ্যেই চলছে। পাশাপাশি, কম আক্রমণাত্মক চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে।

ব্রুফস্কির ভাষায়, ‘আমরা চেষ্টা করছি স্তন ক্যান্সারকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে যেতে, যাতে এটি দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়—আর মানুষ জীবনের শেষে অন্য কারণে মৃত্যু বরণ করে।’
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















