আসিয়ান সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত চুক্তি
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত আসিয়ান (ASEAN) সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রবিবার থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের সঙ্গে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও খনিজ চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।
এই পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চায় চীনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সরবরাহ শৃঙ্খল ও বাণিজ্য ভারসাম্য পুনর্গঠন করতে।
বাণিজ্যে নতুন সুযোগ ও শুল্ক হ্রাসের প্রতিশ্রুতি
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র আপাতত ১৯ শতাংশ শুল্কহার বজায় রাখবে, তবে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে তা শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও একই ধরনের কাঠামোগত চুক্তি ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে বর্তমানে দেশটি ২০ শতাংশ শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে।
ভিয়েতনাম, যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গত বছর ১২৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল, এবার যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি ব্যাপকভাবে বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছে—যাতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পায়।

মালয়েশিয়ার বিরল খনিজ রপ্তানিতে ছাড় ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকারের বিস্তার
ট্রাম্প রবিবার মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে দুটি পৃথক চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা বিরল ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সরবরাহের বিকল্প উৎস তৈরি করবে।
চীনের ওপর বৈশ্বিক নির্ভরতা কমাতে এই পদক্ষেপ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে, কারণ চীন বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ বিরল খনিজ উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণকারী দেশ।
মালয়েশিয়া ঘোষণা করেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বা কোটা আরোপ করবে না, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও রেয়ার আর্থ উপাদানের ক্ষেত্রে।
তবে এই প্রতিশ্রুতি কাঁচা না প্রক্রিয়াজাত খনিজের জন্য প্রযোজ্য—তা স্পষ্ট করা হয়নি।
দেশটিতে প্রায় ১ কোটি ৬১ লাখ টন বিরল খনিজের মজুদ রয়েছে, যা তারা এখন অভ্যন্তরীণ শিল্পে কাজে লাগাতে চায়। এজন্য মালয়েশিয়া কাঁচা খনিজ রপ্তানি বন্ধ রেখেছে, যাতে সম্পদের অপচয় রোধ করা যায়।
চীনের বিকল্প সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল
চীনের কড়া রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের কারণে সেমিকন্ডাক্টর, বৈদ্যুতিক যানবাহন ও সামরিক সরঞ্জামের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ সরবরাহে বৈশ্বিক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে খনিজ সহযোগিতা জোরদার করছে।

চলতি মাসে রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে, চীন ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বিরল খনিজ প্রক্রিয়াকরণে অংশীদারিত্বের বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে—যেখানে মালয়েশিয়ার সার্বভৌম তহবিল ‘খাজানাহ ন্যাশনাল’ চীনা এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে একটি রিফাইনারি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে।
সীমান্ত সংঘাত থামাতে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া চুক্তি
বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরের আগে ট্রাম্প থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে একটি শক্তিশালী যুদ্ধবিরতি চুক্তির তত্ত্বাবধান করেন, যা চলতি বছরের শুরুতে দুই দেশের সীমান্তে হওয়া প্রাণঘাতী সংঘাতের পর স্বাক্ষরিত হয়।
এই পদক্ষেপকেও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শুল্ক বাধা দূর ও বাজার উন্মুক্ত করার অঙ্গীকার
নতুন চুক্তিগুলোর অধীনে চারটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের জন্য বাজার উন্মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এতে ডিজিটাল বাণিজ্য, সেবা খাত ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
একই সঙ্গে এই দেশগুলো শ্রম অধিকার রক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি যানবাহনকে মার্কিন নিরাপত্তা ও নির্গমন মানদণ্ডে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে।
মালয়েশিয়া, যা বিশ্বব্যাপী হালাল সার্টিফিকেশনে শীর্ষস্থানীয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রসাধনী ও ওষুধপণ্য অনুমোদনের প্রক্রিয়া সহজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শিল্প ও পণ্যে শুল্ক ছাড় ও বৃহৎ ক্রয়চুক্তি
মালয়েশিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী তেংকু জাফরুল আজিজ জানান, তারা বিমান ও ওষুধশিল্প পণ্যের পাশাপাশি পাম তেল, কোকো ও রাবারজাতীয় পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে।
থাইল্যান্ড ঘোষণা করেছে, তারা প্রায় ৯৯ শতাংশ পণ্যে শুল্ক বাধা তুলে নেবে এবং টেলিকম খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের জন্য বিদেশি মালিকানার সীমা শিথিল করবে।
দুই দেশ একযোগে কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির কথাও জানিয়েছে, যার আওতায় বছরে আনুমানিক ২৬০ কোটি ডলারের ভুট্টা ও সয়াবিন আমদানি হবে।
থাইল্যান্ড আরও ঘোষণা করেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮০টি বিমান কিনবে, যার মূল্য প্রায় ১৮.৮ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি তরল প্রাকৃতিক গ্যাস ও অপরিশোধিত তেলসহ জ্বালানি পণ্যের বার্ষিক আমদানির পরিমাণ হবে প্রায় ৫.৪ বিলিয়ন ডলার।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন বাণিজ্য ও খনিজ চুক্তিগুলো শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
চীন নির্ভর সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে সরে এসে যুক্তরাষ্ট্র এখন এশিয়ার মধ্যেই নতুন অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হচ্ছে—যা আগামী বছরগুলোতে বৈশ্বিক বাণিজ্য ভারসাম্যে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















