০১:০৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫
জুরং দ্বীপে সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় সবুজ ডেটা সেন্টার পার্ক শক্তিই ন্যায়ের প্রতীক— ক্ষমতার খেলায় ট্রাম্পের ‘শান্তি রাজনীতি’ সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে দম্পতির ব্যতিক্রমী উদ্যোগ জাকার্তায় কুকুরের মাংস নিষিদ্ধের উদ্যোগে প্রতিবাদ ও জনস্বাস্থ্য সতর্কতা স্বর্ণের দাম ধস, বিশ্বজুড়ে ক্রেতাদের হুড়োহুড়ি মালয়েশিয়ার সিনেমায় —ভালোবাসা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে নতুন চলচ্চিত্র রেটিনা আলাদা হয়ে গেলে দেরি নয়, দ্রুত বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়াই সর্বোত্তম প্রোটিন পাউডারে বিপজ্জনক মাত্রার সিসার উপস্থিতি মার্কিন অভিবাসন কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে ব্রিটিশ মুসলিম সাংবাদিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাইওয়ানের ‘সাউথবাউন্ড’ কৌশল: চ্যালেঞ্জের মুখে

আনোয়ার, ট্রাম্প এবং সম্পৃক্ততার কৌশল

কূটনীতিতে অনেক সময় স্নেহপূর্ণ সম্বোধন ও আন্তরিক ভাষা ভূরাজনৈতিক সীমারেখার চেয়েও বেশি কার্যকর হয়। নেতারা যখন উষ্ণতা ও সম্মানের ভাষা ব্যবহার করেন, তখন আস্থা গড়ে ওঠে, সৌহার্দ্য শক্তিশালী হয় এবং আলোচনা ভূরাজনীতির ঝড়ঝাপটা এড়িয়ে চলে। এতে সংলাপ ও সহযোগিতা হয় সহজতর এবং ফলপ্রসূ। কিন্তু এমন ব্যক্তিগত সখ্যতা বিউরোক্র্যাটিক বই বা কূটনৈতিক নীতিমালায় শেখানো যায় না; দরকার নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত রসায়ন, যা কূটনৈতিক ফলাফলকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

রোববার প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাতে ঠিক এমনটাই দেখা গেছে।

ট্রাম্প সম্পর্কে যদি একটি বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তা হলো—তিনি অনিশ্চিত স্বভাবের। ঘটনাপ্রবাহ অন্যভাবেও যেতে পারত; তবু রোববার কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁর আগমন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে ভরা—তিনি স্বাগত নৃত্যে আনন্দে যোগ দিলেন এবং উদার ভঙ্গিতে দুই দেশের পতাকা নাড়িয়ে অভিবাদন জানালেন।

অসাধারণ সৌহার্দ্যের আরেক প্রদর্শনে তিনি আনোয়ারকে নিজের রাষ্ট্রপতি লিমুজিন ‘দ্য বিস্ট’-এ একসঙ্গে চড়ার আমন্ত্রণ জানান—সোজা কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার পর্যন্ত।

এটা ছিল না কোনো সাধারণ যাত্রা, আর যাত্রীও ছিলেন না সাধারণ কেউ। এই তাৎপর্যপূর্ণ সফরের সে মুহূর্ত যে সুযোগ তৈরি করেছে, তাই হয়ে উঠেছে পুরো আয়োজনের মূল আকর্ষণ।

আনোয়ারের জন্য এই সফর প্রায় এক বছরের যুক্তরাষ্ট্র–মালয়েশিয়া সম্পৃক্ততার পরিণতি—যা শুরু হয়েছিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ৫ নভেম্বর ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর।

Anwar holds bilateral meeting with Trump

শিগগিরই পরিষ্কার হয়ে যায়, ট্রাম্প আবারও ওয়াশিংটনের প্রচলিত রীতিনীতি ভাঙবেন—এবার আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে।

ট্রাম্পের খামখেয়ালি আচরণ আগাম অনুমান করার যে কোনো চেষ্টা সিসিফাসের শ্রমের মতো দুরূহ; উল্টো তিনি হয়তো তাতে আরও জোরই দিতেন!

মালয়েশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে আসিয়ানের চেয়ার না নেওয়ার আগেই সরকার বুঝে গিয়েছিল—সালজুড়ে সফলতা অনেকটাই নির্ভর করবে হোয়াইট হাউসের নতুন অধিবাসীর সঙ্গে কেমন করে সম্পৃক্ততা গড়ে তোলা যায় তার ওপর।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে আসিয়ান ধীরে ধীরে একধরনের ক্লান্তি অনুভব করেছিল, অন্তত তাঁর মেয়াদের শেষ দিকে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বাইডেন জাকার্তায় আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন এড়িয়ে যান; বদলে সহ-রাষ্ট্রপতি কামালা হ্যারিসকে পাঠান—আর কয়েক দিনের মধ্যে ভিয়েতনাম সফরে গিয়ে যেন অপমান আরও বাড়ান। আনোয়ারের নিজের বাইডেন–অভিজ্ঞতাও ছিল একই রকম নিস্তেজ—দুই নেতা ২৬ মাস একই সময়ে ক্ষমতায় থাকলেও নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদের একবারও প্রত্যক্ষ কথা হয়নি।

ট্রাম্পের ক্ষেত্রে চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। শপথ নেওয়ার পর নয় মাসে তিনি ও আনোয়ার তিনবার টেলিফোনে কথা বলেছেন। এখানেই স্নেহপূর্ণ সম্বোধনের বীজ বপন হয়েছিল। সাম্প্রতিক স্মৃতিতে এটি আসিয়ান–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ সম্পৃক্ততা হিসেবে প্রমাণিতও হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মেলানো যে কোনো মালয়েশীয় নেতার জন্যই জটিল—বিশেষ করে ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরুর পর থেকে। বাইডেন প্রশাসনের সময় ইসরায়েল যে দায়মুক্তি ভোগ করেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বললেই আলোচনায় ফিলিস্তিন প্রধান হয়ে উঠত। ২০২৩ সালের এপেক সম্মেলনে সান ফ্রান্সিসকোয় আনোয়ার দ্বিধাহীনভাবে বাইডেনের সামনাসামনি গাজার মানবিক বিপর্যয়ের প্রশ্নে কড়া অবস্থান নেন।

ট্রাম্পের আমলেও যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল–নীতি মৌলিকভাবে বদলাবে—এমন ভ্রম নেই। তবু অন্তত এই ধারণা কাজ করে যে তাঁর লেনদেনভিত্তিক, চুক্তিমুখী প্রবণতা তাঁকে ওই সম্পর্কে আদর্শগত বন্দিত্ব থেকে কিছুটা মুক্ত রাখে—যা অপ্রত্যাশিতভাবে সুবিধায় পরিণত হয়েছে।

Malaysia, US unveil sweeping trade pact covering rare earths, energy and US$150b in deals, according to joint statement | Malay Mail

খুব বেশি দিন ধরে ধারাবাহিকভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা একই কৌশল বারবার প্রয়োগ করেছেন, ভিন্ন ফলের আশায়। হেনরি কিসিঞ্জারের স্মৃতির প্রতি সব সম্মান রেখেই বলি—মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ বা পূর্ব এশিয়া—যেখানেই হোক, ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি–প্রতিষ্ঠান বারবার ব্যর্থ হওয়া ধ্যানধারণায় অটল থেকেছে। ট্রাম্প, উল্টোভাবে, এমন প্রথাবাদের ধার ধারেন না। কিম জং–উনের সঙ্গে তাঁর বৈঠক স্থায়ী সমাধান না আনলেও অন্তত এটুকু স্বীকারোক্তি ছিল যে আগের প্রচেষ্টা—উত্তর কোরিয়া স্বেচ্ছায় পারমাণবিক অস্ত্র ছেড়ে দেবে—এই কল্পনার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল; যা কূটনৈতিক উন্মত্ততার শামিল—একই কাজ বারবার করে আলাদা ফল আশা করা।

অনেকেই চাইতেন গাজার যুদ্ধ আরও আগেই থামুক; তবু অস্বীকার করার উপায় নেই যে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ যুদ্ধবিরতি ত্বরান্বিত করেছে। তিনি আরব রাজধানিগুলোর সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন এবং একই সঙ্গে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ওপর চাপও দিয়েছেন—যা তাঁর পূর্বসূরিরা খুব কমই সাহস করতেন, কারণ কংগ্রেসে ইসরায়েলের প্রভাব তাঁদের হাতে–পায়ে শিকল পরিয়ে রাখত—ওয়াশিংটনে যা এখন খোলাখুলি বলা সম্ভব, কারণ বাস্তবতা বেদনাদায়কভাবে স্পষ্ট।

সেই একই ব্যতিক্রমী প্রবণতা প্রয়োগ হয়েছে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়াতেও। এ বছরের শুরুর দিকে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া যখন বিতর্কিত সীমান্তে গোলাগুলি চালায়, ট্রাম্প ও আনোয়ার পরিপূরক ভূমিকা নেন। আনোয়ার মালয়েশিয়া ও আসিয়ানকে নিরপেক্ষ আলোচনার জায়গা হিসেবে প্রস্তাব করেন; ট্রাম্প বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব দেন—সরল করে বললে, বন্দুক থামলে চুক্তি, না থামলে নয়; যদিও বিষয়টি সরল কোনো ‘বন্দুক না মাখন’ দ্বৈততায় নামিয়ে আনা হয়নি।

বিতর্ক সত্ত্বেও রোববার স্বাক্ষরিত ‘কুয়ালালামপুর শান্তি চুক্তি’ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে শান্তি পুনরুদ্ধারের আনুষ্ঠানিক এক ধাপ। মালয়েশিয়ার জন্য ট্রাম্পকে স্বাগত জানানো কেবল প্রোটোকল নয়, বরং অবস্থান নির্ধারণ—দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ কি যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ভূমিকা ও বহুপাক্ষিকতায় অনীহাপূর্ণ এক প্রেসিডেন্টকে গঠনমূলক পথে আনতে পারে—তার পরীক্ষাও বটে। আনোয়ারের সূক্ষ্ম প্রস্তুতি ও শালীন কিন্তু দৃঢ় পরিচালনা পুরো ব্যাপারটিকে সহজসাধ্য বলে মনে করিয়েছে।

শান্তি চুক্তির বাইরেও ট্রাম্পের সফর মালয়েশিয়ার জন্য বাস্তব সুফল এনেছে। প্রকৃতিতে অসমতামূলক হলেও মালয়েশিয়া–যুক্তরাষ্ট্র পারস্পরিক বাণিজ্য চুক্তি (এআরটি) মালয়েশিয়ার ভোক্তা, ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দৃশ্যমান সুবিধা দেবে।

নতুন বাণিজ্য চুক্তি ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজে অংশীদারিত্ব যুক্তরাষ্ট্র–নির্ভর নতুন সরবরাহ–শৃঙ্খলের কাঠামোয় মালয়েশিয়ার অবস্থান আরও মজবুত করবে; ইস্পাত, টেলিযোগাযোগ নিরাপত্তা ও লজিস্টিকসে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমাদের অঙ্গীকারকে জোরদার করবে। এআরটি–এর বিধানগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে দীর্ঘমেয়াদে সুফল মিলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) অনুমোদন মালয়েশিয়া স্বীকৃতি দেওয়ায় উদ্ভাবনী ওষুধ ও চিকিৎসা–ডিভাইস দ্রুত পাওয়া যাবে; বারবার পরীক্ষার প্রয়োজন কমবে।

Photo gallery) US President Donald Trump's first day in Malaysia | The Star

তবে এই চুক্তি নিয়ে সবই যে মসৃণ চলবে, তা ভাবা বোকামি। সমালোচকেরা বলছেন—‘পারস্পরিক’ বলে উপস্থাপিত হলেও কাঠামোগত এক অসমতা আছে: মালয়েশিয়া ব্যাপক উদারীকরণ ও বিধিনিষেধ–সামঞ্জস্যে অঙ্গীকারবদ্ধ, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বিস্তর বিবেচনাধিকার রেখে সীমিত বাধ্যবাধকতা নিয়েছে। বিষয়টি অন্য এক পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ। আপাতত এটুকুই—এআরটি বিনিয়োগকারীদের কাছে এই নিশ্চয়তা জোরালো করে যে মালয়েশিয়ার মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার স্থিতিশীল। সামনে করণীয় হলো এই সম্পৃক্ততা ধরে রাখা এবং সময়ের সঙ্গে আরও অনুকূল বাণিজ্য শর্ত আদায় করা—ধাপে ধাপে যেসব বাধা বাজার–প্রবেশে রয়ে গেছে, সেগুলো হালকা করা।

ট্রাম্পের সফর বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের এক নজির স্থাপন করেছে। দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বছরের মধ্যেই তিনি আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিলেন। চ্যালেঞ্জ হবে—তাঁর কূটনৈতিক সূচিতে আসিয়ানকে ধরে রাখা; ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে প্রশাসনের মনোযোগ সরে গেলে এটি আরও কঠিন হবে।

দায়িত্ব তখন পড়বে ফিলিপাইনের ওপর, যারা আগামী বছর আসিয়ানের চেয়ার নেবে। তাদের হাতে হয়তো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর বা নতুন বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণার মতো আকর্ষণ থাকবে না। তদুপরি, চীনের প্রেসিডেন্ট নিয়মিতভাবে নিজে না এসে প্রধানমন্ত্রীকে পাঠান—এ কথা সত্য হলেও লি চিয়াং যে গুরুত্বহীন নন, তাও ধরা উচিত। কাজেই টান তৈরি করতে হবে আসিয়ানের ভূ–অর্থনৈতিক ওজন দিয়ে—দেখাতে হবে, অঞ্চলটি এখনো ওয়াশিংটনের ভিড় ঠাসা সূচিতে জায়গা পাওয়ার যোগ্য। দিনের শেষে স্পষ্ট হলো—ট্রাম্পের সফর প্রত্যাশার চেয়েও ভালো হয়েছে।

মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব, আসিয়ানের ঐক্য এবং আনোয়ার ব্যক্তিগতভাবে—সবকিছুরই প্রশংসা শোনা গেল। ট্রাম্প তাঁকে ‘এক মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব’ বলে বর্ণনা করেছেন—থাই–কম্বোডিয়া শান্তিচুক্তি সাফল্যে তাঁর ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে।

যা বাইরে থেকে নির্বিঘ্ন বলে মনে হয়েছে, তা আসলে ছিল দীর্ঘ প্রস্তুতি ও সুচিন্তিত রাষ্ট্রনীতির ফল—কূটনীতির স্নেহপূর্ণ সম্বোধন, ব্যক্তিগত রসায়ন ও পারস্পরিক সখ্যতার সূক্ষ্ম মিশ্রণে দৃঢ়ভাবে সাজানো।

লেখক: মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (আইএসআইএস)–এর চেয়ারম্যান

জনপ্রিয় সংবাদ

জুরং দ্বীপে সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় সবুজ ডেটা সেন্টার পার্ক

আনোয়ার, ট্রাম্প এবং সম্পৃক্ততার কৌশল

০৮:০০:৩৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

কূটনীতিতে অনেক সময় স্নেহপূর্ণ সম্বোধন ও আন্তরিক ভাষা ভূরাজনৈতিক সীমারেখার চেয়েও বেশি কার্যকর হয়। নেতারা যখন উষ্ণতা ও সম্মানের ভাষা ব্যবহার করেন, তখন আস্থা গড়ে ওঠে, সৌহার্দ্য শক্তিশালী হয় এবং আলোচনা ভূরাজনীতির ঝড়ঝাপটা এড়িয়ে চলে। এতে সংলাপ ও সহযোগিতা হয় সহজতর এবং ফলপ্রসূ। কিন্তু এমন ব্যক্তিগত সখ্যতা বিউরোক্র্যাটিক বই বা কূটনৈতিক নীতিমালায় শেখানো যায় না; দরকার নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত রসায়ন, যা কূটনৈতিক ফলাফলকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

রোববার প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাতে ঠিক এমনটাই দেখা গেছে।

ট্রাম্প সম্পর্কে যদি একটি বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তা হলো—তিনি অনিশ্চিত স্বভাবের। ঘটনাপ্রবাহ অন্যভাবেও যেতে পারত; তবু রোববার কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁর আগমন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে ভরা—তিনি স্বাগত নৃত্যে আনন্দে যোগ দিলেন এবং উদার ভঙ্গিতে দুই দেশের পতাকা নাড়িয়ে অভিবাদন জানালেন।

অসাধারণ সৌহার্দ্যের আরেক প্রদর্শনে তিনি আনোয়ারকে নিজের রাষ্ট্রপতি লিমুজিন ‘দ্য বিস্ট’-এ একসঙ্গে চড়ার আমন্ত্রণ জানান—সোজা কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার পর্যন্ত।

এটা ছিল না কোনো সাধারণ যাত্রা, আর যাত্রীও ছিলেন না সাধারণ কেউ। এই তাৎপর্যপূর্ণ সফরের সে মুহূর্ত যে সুযোগ তৈরি করেছে, তাই হয়ে উঠেছে পুরো আয়োজনের মূল আকর্ষণ।

আনোয়ারের জন্য এই সফর প্রায় এক বছরের যুক্তরাষ্ট্র–মালয়েশিয়া সম্পৃক্ততার পরিণতি—যা শুরু হয়েছিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ৫ নভেম্বর ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর।

Anwar holds bilateral meeting with Trump

শিগগিরই পরিষ্কার হয়ে যায়, ট্রাম্প আবারও ওয়াশিংটনের প্রচলিত রীতিনীতি ভাঙবেন—এবার আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে।

ট্রাম্পের খামখেয়ালি আচরণ আগাম অনুমান করার যে কোনো চেষ্টা সিসিফাসের শ্রমের মতো দুরূহ; উল্টো তিনি হয়তো তাতে আরও জোরই দিতেন!

মালয়েশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে আসিয়ানের চেয়ার না নেওয়ার আগেই সরকার বুঝে গিয়েছিল—সালজুড়ে সফলতা অনেকটাই নির্ভর করবে হোয়াইট হাউসের নতুন অধিবাসীর সঙ্গে কেমন করে সম্পৃক্ততা গড়ে তোলা যায় তার ওপর।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে আসিয়ান ধীরে ধীরে একধরনের ক্লান্তি অনুভব করেছিল, অন্তত তাঁর মেয়াদের শেষ দিকে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বাইডেন জাকার্তায় আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন এড়িয়ে যান; বদলে সহ-রাষ্ট্রপতি কামালা হ্যারিসকে পাঠান—আর কয়েক দিনের মধ্যে ভিয়েতনাম সফরে গিয়ে যেন অপমান আরও বাড়ান। আনোয়ারের নিজের বাইডেন–অভিজ্ঞতাও ছিল একই রকম নিস্তেজ—দুই নেতা ২৬ মাস একই সময়ে ক্ষমতায় থাকলেও নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদের একবারও প্রত্যক্ষ কথা হয়নি।

ট্রাম্পের ক্ষেত্রে চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। শপথ নেওয়ার পর নয় মাসে তিনি ও আনোয়ার তিনবার টেলিফোনে কথা বলেছেন। এখানেই স্নেহপূর্ণ সম্বোধনের বীজ বপন হয়েছিল। সাম্প্রতিক স্মৃতিতে এটি আসিয়ান–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ সম্পৃক্ততা হিসেবে প্রমাণিতও হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মেলানো যে কোনো মালয়েশীয় নেতার জন্যই জটিল—বিশেষ করে ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরুর পর থেকে। বাইডেন প্রশাসনের সময় ইসরায়েল যে দায়মুক্তি ভোগ করেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বললেই আলোচনায় ফিলিস্তিন প্রধান হয়ে উঠত। ২০২৩ সালের এপেক সম্মেলনে সান ফ্রান্সিসকোয় আনোয়ার দ্বিধাহীনভাবে বাইডেনের সামনাসামনি গাজার মানবিক বিপর্যয়ের প্রশ্নে কড়া অবস্থান নেন।

ট্রাম্পের আমলেও যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল–নীতি মৌলিকভাবে বদলাবে—এমন ভ্রম নেই। তবু অন্তত এই ধারণা কাজ করে যে তাঁর লেনদেনভিত্তিক, চুক্তিমুখী প্রবণতা তাঁকে ওই সম্পর্কে আদর্শগত বন্দিত্ব থেকে কিছুটা মুক্ত রাখে—যা অপ্রত্যাশিতভাবে সুবিধায় পরিণত হয়েছে।

Malaysia, US unveil sweeping trade pact covering rare earths, energy and US$150b in deals, according to joint statement | Malay Mail

খুব বেশি দিন ধরে ধারাবাহিকভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা একই কৌশল বারবার প্রয়োগ করেছেন, ভিন্ন ফলের আশায়। হেনরি কিসিঞ্জারের স্মৃতির প্রতি সব সম্মান রেখেই বলি—মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ বা পূর্ব এশিয়া—যেখানেই হোক, ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি–প্রতিষ্ঠান বারবার ব্যর্থ হওয়া ধ্যানধারণায় অটল থেকেছে। ট্রাম্প, উল্টোভাবে, এমন প্রথাবাদের ধার ধারেন না। কিম জং–উনের সঙ্গে তাঁর বৈঠক স্থায়ী সমাধান না আনলেও অন্তত এটুকু স্বীকারোক্তি ছিল যে আগের প্রচেষ্টা—উত্তর কোরিয়া স্বেচ্ছায় পারমাণবিক অস্ত্র ছেড়ে দেবে—এই কল্পনার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল; যা কূটনৈতিক উন্মত্ততার শামিল—একই কাজ বারবার করে আলাদা ফল আশা করা।

অনেকেই চাইতেন গাজার যুদ্ধ আরও আগেই থামুক; তবু অস্বীকার করার উপায় নেই যে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ যুদ্ধবিরতি ত্বরান্বিত করেছে। তিনি আরব রাজধানিগুলোর সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন এবং একই সঙ্গে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ওপর চাপও দিয়েছেন—যা তাঁর পূর্বসূরিরা খুব কমই সাহস করতেন, কারণ কংগ্রেসে ইসরায়েলের প্রভাব তাঁদের হাতে–পায়ে শিকল পরিয়ে রাখত—ওয়াশিংটনে যা এখন খোলাখুলি বলা সম্ভব, কারণ বাস্তবতা বেদনাদায়কভাবে স্পষ্ট।

সেই একই ব্যতিক্রমী প্রবণতা প্রয়োগ হয়েছে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়াতেও। এ বছরের শুরুর দিকে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া যখন বিতর্কিত সীমান্তে গোলাগুলি চালায়, ট্রাম্প ও আনোয়ার পরিপূরক ভূমিকা নেন। আনোয়ার মালয়েশিয়া ও আসিয়ানকে নিরপেক্ষ আলোচনার জায়গা হিসেবে প্রস্তাব করেন; ট্রাম্প বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব দেন—সরল করে বললে, বন্দুক থামলে চুক্তি, না থামলে নয়; যদিও বিষয়টি সরল কোনো ‘বন্দুক না মাখন’ দ্বৈততায় নামিয়ে আনা হয়নি।

বিতর্ক সত্ত্বেও রোববার স্বাক্ষরিত ‘কুয়ালালামপুর শান্তি চুক্তি’ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে শান্তি পুনরুদ্ধারের আনুষ্ঠানিক এক ধাপ। মালয়েশিয়ার জন্য ট্রাম্পকে স্বাগত জানানো কেবল প্রোটোকল নয়, বরং অবস্থান নির্ধারণ—দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ কি যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ভূমিকা ও বহুপাক্ষিকতায় অনীহাপূর্ণ এক প্রেসিডেন্টকে গঠনমূলক পথে আনতে পারে—তার পরীক্ষাও বটে। আনোয়ারের সূক্ষ্ম প্রস্তুতি ও শালীন কিন্তু দৃঢ় পরিচালনা পুরো ব্যাপারটিকে সহজসাধ্য বলে মনে করিয়েছে।

শান্তি চুক্তির বাইরেও ট্রাম্পের সফর মালয়েশিয়ার জন্য বাস্তব সুফল এনেছে। প্রকৃতিতে অসমতামূলক হলেও মালয়েশিয়া–যুক্তরাষ্ট্র পারস্পরিক বাণিজ্য চুক্তি (এআরটি) মালয়েশিয়ার ভোক্তা, ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দৃশ্যমান সুবিধা দেবে।

নতুন বাণিজ্য চুক্তি ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজে অংশীদারিত্ব যুক্তরাষ্ট্র–নির্ভর নতুন সরবরাহ–শৃঙ্খলের কাঠামোয় মালয়েশিয়ার অবস্থান আরও মজবুত করবে; ইস্পাত, টেলিযোগাযোগ নিরাপত্তা ও লজিস্টিকসে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমাদের অঙ্গীকারকে জোরদার করবে। এআরটি–এর বিধানগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে দীর্ঘমেয়াদে সুফল মিলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) অনুমোদন মালয়েশিয়া স্বীকৃতি দেওয়ায় উদ্ভাবনী ওষুধ ও চিকিৎসা–ডিভাইস দ্রুত পাওয়া যাবে; বারবার পরীক্ষার প্রয়োজন কমবে।

Photo gallery) US President Donald Trump's first day in Malaysia | The Star

তবে এই চুক্তি নিয়ে সবই যে মসৃণ চলবে, তা ভাবা বোকামি। সমালোচকেরা বলছেন—‘পারস্পরিক’ বলে উপস্থাপিত হলেও কাঠামোগত এক অসমতা আছে: মালয়েশিয়া ব্যাপক উদারীকরণ ও বিধিনিষেধ–সামঞ্জস্যে অঙ্গীকারবদ্ধ, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বিস্তর বিবেচনাধিকার রেখে সীমিত বাধ্যবাধকতা নিয়েছে। বিষয়টি অন্য এক পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ। আপাতত এটুকুই—এআরটি বিনিয়োগকারীদের কাছে এই নিশ্চয়তা জোরালো করে যে মালয়েশিয়ার মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার স্থিতিশীল। সামনে করণীয় হলো এই সম্পৃক্ততা ধরে রাখা এবং সময়ের সঙ্গে আরও অনুকূল বাণিজ্য শর্ত আদায় করা—ধাপে ধাপে যেসব বাধা বাজার–প্রবেশে রয়ে গেছে, সেগুলো হালকা করা।

ট্রাম্পের সফর বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের এক নজির স্থাপন করেছে। দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বছরের মধ্যেই তিনি আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিলেন। চ্যালেঞ্জ হবে—তাঁর কূটনৈতিক সূচিতে আসিয়ানকে ধরে রাখা; ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে প্রশাসনের মনোযোগ সরে গেলে এটি আরও কঠিন হবে।

দায়িত্ব তখন পড়বে ফিলিপাইনের ওপর, যারা আগামী বছর আসিয়ানের চেয়ার নেবে। তাদের হাতে হয়তো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর বা নতুন বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণার মতো আকর্ষণ থাকবে না। তদুপরি, চীনের প্রেসিডেন্ট নিয়মিতভাবে নিজে না এসে প্রধানমন্ত্রীকে পাঠান—এ কথা সত্য হলেও লি চিয়াং যে গুরুত্বহীন নন, তাও ধরা উচিত। কাজেই টান তৈরি করতে হবে আসিয়ানের ভূ–অর্থনৈতিক ওজন দিয়ে—দেখাতে হবে, অঞ্চলটি এখনো ওয়াশিংটনের ভিড় ঠাসা সূচিতে জায়গা পাওয়ার যোগ্য। দিনের শেষে স্পষ্ট হলো—ট্রাম্পের সফর প্রত্যাশার চেয়েও ভালো হয়েছে।

মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব, আসিয়ানের ঐক্য এবং আনোয়ার ব্যক্তিগতভাবে—সবকিছুরই প্রশংসা শোনা গেল। ট্রাম্প তাঁকে ‘এক মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব’ বলে বর্ণনা করেছেন—থাই–কম্বোডিয়া শান্তিচুক্তি সাফল্যে তাঁর ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে।

যা বাইরে থেকে নির্বিঘ্ন বলে মনে হয়েছে, তা আসলে ছিল দীর্ঘ প্রস্তুতি ও সুচিন্তিত রাষ্ট্রনীতির ফল—কূটনীতির স্নেহপূর্ণ সম্বোধন, ব্যক্তিগত রসায়ন ও পারস্পরিক সখ্যতার সূক্ষ্ম মিশ্রণে দৃঢ়ভাবে সাজানো।

লেখক: মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (আইএসআইএস)–এর চেয়ারম্যান