সংক্ষিপ্তসার
— আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে দলের বহু সমর্থক ভোট দেবেন না
— তিনি এখন দিল্লিতে; দেশে ফেরার শর্ত—বৈধ সরকার ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি
— তাঁর দলের অংশগ্রহণ ছাড়া গঠিত সরকারকে মানবেন না বলে জানালেন
— অন্তর্বর্তী সরকার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে
নয়াদিল্লি/ঢাকা, ২৯ অক্টোবর ২০২৫—বাংলাদেশের আওয়ামী লীগকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়ায় দলের বহু সমর্থক ভোট দেবে না—এ কথা জানিয়েছেন নির্বাসিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নয়াদিল্লিতে অবস্থান থেকে তিনি ই-মেইলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন।
৭৮ বছর বয়সী হাসিনা বলেন, নির্বাচনে তাঁর দলের অংশগ্রহন ছাড়া যে সরকারই গঠিত হোক, সেই সরকারের অধীনে তিনি দেশে ফিরবেন না। ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্রনেতৃত্বাধীন সহিংস আন্দোলনের পর তিনি ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই আছেন।
বর্তমানে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তারা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছে।
হাসিনার ভাষায়, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা অন্যায় এবং দেশের জন্য ক্ষতিকর। তিনি বলেন, পরবর্তী সরকারের নির্বাচনী বৈধতা থাকা জরুরি। তাঁর দাবি—আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন এমন বিপুল মানুষ বর্তমান অবস্থায় ভোট দেবেন না; কার্যকর রাজনীতি চাইলে এত মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না।

আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের দাবি
বাংলাদেশে নিবন্ধিত ভোটার প্রায় ১২ কোটি ৬০ লাখ। দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রভাবশালী। আসন্ন ভোটে বিএনপির এগিয়ে থাকার আভাসও আছে।
গত মে মাসে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে। এর আগে ইউনুসের নেতৃত্বে সরকার জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ তদন্তের কথা বলে দলের সব রাজনৈতিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের ভোটারদের অন্য দলে যেতে বলা হচ্ছে না; বরং আশা করা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত সরকার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে।
তিনি বা তাঁর প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কোনো অন্তরাল আলোচনায় আছেন কি না—এ বিষয়ে তিনি কিছু জানাননি। ইউনুসের পক্ষ থেকেও তাৎক্ষণিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার ইস্যু ও মামলার অগ্রগতি
অর্থনীতিতে উন্নতির কৃতিত্ব থাকলেও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিরোধী মত দমনের অভিযোগে হাসিনা সমালোচিত। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি টানা চতুর্থবার জয়ী হন; তবে প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছিল—তাদের শীর্ষরা কেউ জেলে, কেউ বিদেশে ছিলেন।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁর বিরুদ্ধে মামলার বিচার শেষ করেছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি ছাত্র আন্দোলন দমনের সময় সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে বিক্ষোভে সর্বোচ্চ ১,৪০০ জন নিহত এবং হাজারো মানুষ আহত হন; অধিকাংশের মৃত্যু নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে। ১৯৭১ সালের পর এটিই সবচেয়ে বড় সহিংসতা বলে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগপক্ষের দাবি, গোপন হেফাজতকেন্দ্রের মাধ্যমে বিরোধী কর্মীদের গুম ও নির্যাতনের তদারকি করা হয়েছে। এই মামলার রায় ১৩ নভেম্বর ঘোষণার কথা।
হাসিনা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারে বা অন্য কোনো অপরাধে তিনি ব্যক্তিগতভাবে জড়িত নন। তাঁর ভাষায়, এ বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; আগেভাগেই রায় ঠিক করে রাখা হয়েছে এবং তাঁকে যথাযথভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।

দেশে ফেরার শর্ত
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও হাসিনা মনে করেন, আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে সরকারে বা বিরোধীপক্ষে—কোনো না কোনোভাবে—দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দলের নেতৃত্ব তাঁর পরিবারেই থাকবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বলেও তিনি জানান।
তাঁর ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ—যিনি ওয়াশিংটনে থাকেন—গত বছর জানিয়েছিলেন, দল চাইলে নেতৃত্বের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।
হাসিনা বলেন, কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য সংবিধানসম্মত শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় ফিরে যাওয়া জরুরি; এক ব্যক্তি বা একটি পরিবার দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে না। ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানে তাঁর বাবা ও তিন ভাই নিহত হন; সেই পারিবারিক অভিজ্ঞতা থেকে সতর্ক থাকলেও তিনি দিল্লিতে তুলনামূলক স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন।
কয়েক মাস আগে দিল্লির লোধি গার্ডেনে তাঁকে হাঁটতে দেখা যায়—সঙ্গে ছিলেন দুই নিরাপত্তারক্ষী বলে ধারণা করা হয়। পথচারীরা চিনলে তিনি মাথা নেড়ে অভিবাদন জানান।
তিনি বলেন, দেশে নিশ্চয়ই ফিরতে চান—তবে শর্ত হলো বৈধ সরকার, সংবিধান মানা এবং আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক থাকা।
সাম্প্রতিক উত্তেজনা
হাসিনার দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর লক্ষ্যভিত্তিক সহিংসতা দেখা দেয়। পরে পরিস্থিতি তুলনামূলক শান্ত হলেও চলতি মাসের শুরুর দিকে রাষ্ট্র সংস্কার নীতিপত্রে স্বাক্ষরকে ঘিরে আবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
সংবাদ সংকলন: নয়াদিল্লিতে কৃষ্ণ এন. দাস ও ঢাকায় রুমা পল; অতিরিক্ত প্রতিবেদন: নয়াদিল্লিতে সরিতা চাগান্তি সিংহ; সম্পাদনা: কিম কগহিল
কৃষ্ণ এন. দাস, রুমা পল 


















