গিয়ংজুতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যস্ত কূটনৈতিক দিন
দক্ষিণ কোরিয়ার গিয়ংজু শহরে বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিউংএর সঙ্গে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ইস্যুতে বৈঠক করেন। ট্রাম্প জানান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে তিনি আশাবাদী। বৃহস্পতিবার তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলেই নিশ্চিত করেন।
উত্তর কোরিয়া ট্রাম্পের আগমনের কয়েক ঘণ্টা আগে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়, যা আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়।
বাজার স্থিতিশীলতার বার্তা ও ‘চীনের সঙ্গে আশাবাদ’
বিমানযাত্রার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ট্রাম্প বলেন, “আমি খুবই আশাবাদী। আমাদের দেশের জন্য এবং বিশ্বের জন্য ভালো ফলাফল হবে।”
শির সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকের আশায় বৈশ্বিক বাজারে গত মাসে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে, যদিও দুই দেশের মধ্যে নতুন করে বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা ছিল।
ওয়াশিংটন চীনের বিরল খনিজ রপ্তানি, নিয়ন্ত্রণকে উত্তেজনার কারণ বলছে; অপরদিকে বেইজিং বলছে, যুক্তরাষ্ট্রই চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর বিনিয়োগ সীমাবদ্ধ করে পরিস্থিতি জটিল করেছে।
ফেন্টানিল পাচার, উন্নতমানের চিপ রপ্তানি, বিরল খনিজ ও সয়াবিন বাণিজ্য—এই চারটি ক্ষেত্র দুই দেশের মধ্যে প্রধান বিরোধের বিষয়।
‘টেকনোলজি প্রসপারিটি ডিল’: নতুন কৌশলগত সমঝোতা
হোয়াইট হাউস ঘোষণা করেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংসহ উন্নত প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক (MOU) স্বাক্ষর করেছে।
এই চুক্তি—‘টেকনোলজি প্রসপারিটি ডিল’—এর আওতায় যৌথ AI নীতিমালা তৈরি, প্রযুক্তি রপ্তানিতে অংশীদারিত্ব, ফার্মাসিউটিক্যাল ও জৈবপ্রযুক্তি সরবরাহ চেইন সুরক্ষা এবং মহাকাশ গবেষণায় সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
দক্ষিণ কোরিয়ার এআই ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ক কর্মকর্তা হা জং উ বলেন, “আমরা দুই দেশের বেসরকারি খাতকে যুক্ত করে বাস্তব ফলাফল অর্জনে কাজ চালিয়ে যাব।”
বাজারে উল্লাস, চিপ শিল্পে আশাবাদ
ট্রাম্পের মন্তব্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ওয়ন মুদ্রা ডলারের বিপরীতে ০.৫ শতাংশ শক্তিশালী হয়। সেদিন কসপি সূচক ১.৭৬ শতাংশ বেড়ে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে।
এআই খাতের সম্ভাবনা দেশটির সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে নতুন উদ্দীপনা দিয়েছে। এনভিডিয়া’র সরবরাহকারী এসকে হাইনিক্সের শেয়ার ৭.১ শতাংশ বেড়ে যায়।
ট্রাম্পের ডিনার কূটনীতি
গিয়ংজুর ঐতিহাসিক আর্টস সেন্টারে প্রেসিডেন্ট লি ট্রাম্পের জন্য রাজকীয় নৈশভোজের আয়োজন করেন। মেন্যুতে ছিল মার্কিন গরুর মাংসে তৈরি ‘কোরিয়ান প্ল্যাটার অব সিনসিয়ারিটি’, ঐতিহ্যবাহী কিমচি, বিফ প্যাটিস ও ‘পিসমেকারস ডেজার্ট’ নামের সোনার অলঙ্করণযুক্ত ব্রাউনি।
এই নৈশভোজে অংশ নেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি, অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্থনি আলবানিজ, থাইল্যান্ডের অনুতিন চার্নভিরাকুল, নিউজিল্যান্ডের ক্রিস্টোফার লাকসন এবং সিঙ্গাপুরের লরেন্স ওং।
গিয়ংজুতে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ
ট্রাম্পবিরোধী শতাধিক প্রতিবাদকারী গিয়ংজুতে সমবেত হয়ে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। তারা ‘নো কিংস’ শ্লোগানে ট্রাম্পের স্বৈরাচারী মনোভাব ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
র্যালিতে বিশাল এক ব্যানারে ট্রাম্পের ছবি প্রদর্শিত হয়।
জাপান, চীন ও আঞ্চলিক সমীকরণ
ট্রাম্পের সফরের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল জাপান সফর। মঙ্গলবার টোকিওতে তিনি জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির অঙ্গীকারকে স্বাগত জানান।
তাকাইচি ও শি জিনপিংও শুক্রবার এপেক সম্মেলনে মুখোমুখি বৈঠকে বসবেন।
ট্রাম্প দাবি করেন, টয়োটা যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বিলিয়ন ডলারের নতুন বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যদিও সংস্থাটির নির্বাহীরা এ দাবি অস্বীকার করেন।
চীন–মার্কিন বাণিজ্য আলোচনায় নতুন মাত্রা
ট্রাম্প বৃহস্পতিবারের বৈঠকে শির সঙ্গে এনভিডিয়ার সর্বাধুনিক ব্ল্যাকওয়েল এআই চিপ নিয়েও কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।
ওয়াশিংটন এনভিডিয়াকে চীনে উন্নতমানের এআই চিপ বিক্রি করতে নিষেধ করেছে, যুক্তি দেখিয়ে, যে সেগুলো চীনা সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হতে পারে।
এনভিডিয়ার প্রধান জেনসেন হুয়াং বলেন, “আমরা এখনো রপ্তানি লাইসেন্সের আবেদন করিনি, তবে আশা করি ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বদলাবে, কারণ চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার।”
সয়াবিন ও ফেন্টানিল ইস্যুতে নতুন সংকেত
চীনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান COFCO যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন তিনটি সয়াবিন চালান কিনেছে। এটি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রথম এমন ক্রয়, যা ট্রাম্প–শি বৈঠকের আগমুহূর্তে ঘটে।
এছাড়া, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ফেন্টানিল সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত। বেইজিং বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ‘বাস্তব পদক্ষেপ’ নেয়, তাহলে সহযোগিতা আরও গভীর হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন আকাঙ্ক্ষা
প্রেসিডেন্ট লি ট্রাম্পকে জানান, দক্ষিণ কোরিয়া পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন নির্মাণে জ্বালানি সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি চায়, যদিও সেগুলো পারমাণবিক অস্ত্রবাহী হবে না।
লি বলেন, “ডিজেল সাবমেরিন সীমিত ক্ষমতার হওয়ায়, উত্তর বা চীনের সাবমেরিন ট্র্যাক করতে আমাদের কষ্ট হয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চাপও কমাতে পারে।”
তবে যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবে এ ধরনের প্রকল্পে সবসময় অনাগ্রহ দেখিয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় ট্রাম্পের এই সফরকে একদিকে বাণিজ্য ও প্রযুক্তি সহযোগিতার অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে, অন্যদিকে আঞ্চলিক উত্তেজনার মধ্যে তার উপস্থিতি কূটনৈতিক ভারসাম্যের পরীক্ষাও বটে।
চীনের সঙ্গে বৃহস্পতিবারের বৈঠক যদি ফলপ্রসূ হয়, তবে তা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনীতিতেও নতুন দিশা দিতে পারে।
# ট্রাম্প_#দক্ষিণ_কোরিয়া, #মার্কিন_#চীন_বাণিজ্য, #এপেক_সম্মেলন,# উত্তর_কোরিয়া_#ক্ষেপণাস্ত্র,# কৃত্রিম_বুদ্ধিমত্তা, #আন্তর্জাতিক_সম্পর্ক, #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















