নদীর গল্পে শুরু—লৌহজংয়ের পরিচয়
বাংলাদেশের নদীনির্ভর ভূগোলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ টাঙ্গাইল জেলা। এই জেলার বুক চিরে যে নদীগুলো শত শত বছর ধরে মানুষের জীবন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ধারা বহন করে আসছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো লৌহজং নদী। টাঙ্গাইল শহরের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা এই নদী একসময় ছিল যমুনার উপনদী। স্থানীয় ভাষায় কেউ একে “লৌহঝুঁই” বলতেও ভালোবাসে।
কথিত আছে, “লৌহজং” নামটি এসেছে “লৌহ” (লোহা) এবং “জং” (জল বা প্রবাহ) শব্দদ্বয়ের সংমিশ্রণে, অর্থাৎ এমন একটি নদী যার জলে ছিল শক্তি, প্রবল স্রোত, আর মানুষের জীবনে প্রভাব। কিন্তু আজ সেই নদী কেবল স্মৃতির স্রোতে ভাসছে—নাব্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় টিকে আছে কেবল মানচিত্রে।
ভূগোল ও প্রবাহপথ
লৌহজং নদী মূলত যমুনার শাখা নদী হিসেবে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, নাগরপুর, সখীপুর ও সদর এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো। একসময় এই নদীর জলধারা বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে উঠত, শস্যভরা মাঠে সেচ দিত, মাছের প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করত, আর শীতকালে মানুষের জীবন ও ব্যবসায়িক চলাচলের অন্যতম মাধ্যম ছিল।
বর্তমানে নদীটি শুকিয়ে ক্ষীণধারায় রূপ নিয়েছে। টাঙ্গাইল শহরের পাশ দিয়ে যে অংশটি গেছে, সেটি এখন প্রায় বদ্ধ নালার মতো। অবৈধ দখল, বর্জ্য ফেলা ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের চাপে লৌহজংয়ের প্রাকৃতিক প্রবাহ বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
ইতিহাসের আয়নায় লৌহজং
ঐতিহাসিক দলিল ও স্থানীয় প্রবীণদের মুখে জানা যায়, একসময় লৌহজং ছিল আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। নৌকা ছিল মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। টাঙ্গাইল, নাগরপুর, দেলদুয়ার ও মধুপুরের কৃষকরা তাদের ধান, পাট, তিল, গম, কলাইসহ নানা ফসল এই নদীপথে বাজারে আনত।
লৌহজং নদী শুধু বাণিজ্যের পথই ছিল না—এ ছিল সংস্কৃতি, সাহিত্য ও লোকজ সংগীতের অনুপ্রেরণার উৎস। “পালাগান”, “ভাটিয়ালি”, “মুর্শিদি” গান এই নদীর তীরে রাতভর চলত। নদীর বুক ভরা চাঁদের আলোয় তখন জীবনের আনন্দের গল্প বলা হতো।
নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক
টাঙ্গাইলের গ্রামীণ জীবনে লৌহজং নদী একসময় ছিল আশীর্বাদ। এর জলেই ধান, পাট ও সবজির ফসল হতো। নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবিকা ছিল নৌচালনা, মাছ ধরা, পাটকাটা, কাঠ ব্যবসা, এমনকি মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত।
“লৌহজং না থাকলে আমাদের জীবন থেমে যেত”—এমন মন্তব্য শোনা যায় নদীতীরের বৃদ্ধ কৃষক রহিম মোল্লার মুখে। নদীর জলই ছিল তাঁর পরিবারের আশা। শীতকালে নদীর পাড়ে জমে উঠত হাট, নৌকার গান, পাট শুকানোর দৃশ্য, আর বর্ষায় নদীর বুক ভরা নৌযাত্রা যেন ছিল এক উৎসব।
প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত গুরুত্ব
লৌহজং নদী একসময় ছিল স্থানীয় প্রতিবেশ ব্যবস্থার (ইকোসিস্টেম) অন্যতম ভিত্তি। বর্ষার সময় এটি আশপাশের জমিতে সেচের ব্যবস্থা করত, এবং শীতকালে জমিতে পলি জমিয়ে উর্বরতা বাড়াত। নদীর জলে জন্ম নিত নানান প্রজাতির মাছ—শোল, ট্যাংরা, কাতলা, মাগুর, রুই, মৃগেল ইত্যাদি।
নদীর তীরবর্তী বিল ও খালগুলো ছিল পাখি, কচ্ছপ ও উভচর প্রাণীর আবাসস্থল। লৌহজংয়ের তীরেই এখনো দেখা মেলে সাদা বক, পানকৌড়ি, ডাহুক ও চখাচখি পাখির। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হলো—নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এই প্রাণবৈচিত্র্যও বিলুপ্তির পথে।
নদী দখল ও দূষণের করুণ বাস্তবতা
বর্তমানে লৌহজং নদীর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দখল ও দূষণ। টাঙ্গাইল শহরের বর্জ্য, প্লাস্টিক, গৃহস্থালির ময়লা সরাসরি ফেলা হয় নদীতে। শহরের বিভিন্ন অংশে নদীর জমি ভরাট করে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা, দোকানঘর, এমনকি আবাসিক ভবনও।
নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি বের হতে না পারায় এখন টাঙ্গাইল শহরের অনেক এলাকা জলাবদ্ধ থাকে। বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের রাস্তাঘাটে হাঁটু সমান পানি জমে—যার মূল কারণ লৌহজংয়ের মৃতপ্রায় অবস্থা।
স্থানীয়দের আন্দোলন ও পুনরুদ্ধারের দাবি
নদী রক্ষায় স্থানীয় সচেতন নাগরিক সমাজ, পরিবেশকর্মী ও শিক্ষার্থীরা বহুবার মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচি করেছেন। “লৌহজং বাঁচাও আন্দোলন” নামে একটি স্থানীয় সংগঠন ২০১৮ সালে গঠিত হয়। তারা নদী পুনরুদ্ধারে নিয়মিত প্রচারণা চালাচ্ছে, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে আবেদন জানিয়েছে।
তাদের দাবিগুলো হলো—
১. নদী থেকে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা।
২. নদীর তলদেশ খনন করে প্রাকৃতিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা।
৩. নদীর দুই তীরে গাছ লাগানো ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ।
৪. বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক নীতিমালা প্রণয়ন।
প্রশাসনের উদ্যোগ
২০২২ সালে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন “নদী রক্ষা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প” হাতে নেয়, যার আওতায় লৌহজং নদীর প্রাথমিক জরিপ সম্পন্ন করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নদীর গভীরতা ও প্রস্থ নির্ধারণ করে সম্ভাব্য খনন পরিকল্পনা তৈরি করে।
কিন্তু প্রকল্পটি এখনো বাস্তবায়ন পর্যায়ে পৌঁছায়নি। সরকারি কাগজে পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে নদী এখনো কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ছে। স্থানীয়দের ভাষায়—“কাগজে নদী আছে, মাঠে নেই।”
কৃষি ও জীবিকার ওপর প্রভাব
নদী হারানোর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে কৃষিতে। একসময় লৌহজংয়ের জলেই পুরো মৌসুমে সেচ হতো। এখন কৃষকরা নির্ভর করছেন ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত পাম্পে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ।
মাছ ধরা পেশা থেকেও অনেক পরিবার সরে গেছে। আগে এই নদী থেকেই তারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন নদীতে মাছ নেই, জলও নেই—ফলে তারা অন্য পেশায় যোগ দিয়েছে।
সংস্কৃতি, সাহিত্য ও নদী
লৌহজং শুধু একটি নদী নয়, এটি টাঙ্গাইলের সংস্কৃতির প্রাণ। অনেক স্থানীয় কবি ও গায়ক তাঁদের গানে এই নদীর কথা বলেছেন। “ভাটিয়ালি” গানের সুর, “নৌকাবাইচ”-এর আনন্দ, কিংবা “নদী তীরে মেলা”—সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল এই নদী।
লোককথায় আছে, একসময় লৌহজং নদীতে বর্ষার দিনে ‘বাউল’ ও ‘মুর্শিদি’ গানের আসর বসত। বেহুলা–লখিন্দরের পালাগানেও এই নদীর নাম এসেছে প্রতীক হিসেবে—যেখানে নদী মানে ছিল জীবনের স্রোত, ভালোবাসা ও হারানোর কষ্ট।
নদীর ভবিষ্যৎ: পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লৌহজং এখনো বাঁচানো সম্ভব। সঠিক পরিকল্পনা, নিয়মিত খনন ও জনগণের অংশগ্রহণ থাকলে এই নদী আবারও টাঙ্গাইলের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারে।
এ জন্য দরকার—
- নদী খনন ও পলি অপসারণের প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন
- নদীর তীর দখলমুক্ত রাখা
- স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা
- পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ
যদি এসব পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তবে লৌহজং আবারও তার হারানো স্রোত ফিরে পেতে পারে, আর টাঙ্গাইলের মানুষ ফিরে পেতে পারে তাদের প্রাচীন নদীজীবনের ছন্দ।
টাঙ্গাইলের লৌহজং নদী কেবল একটি জলধারা নয়—এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, জীবিকা ও মানবসম্পর্কের প্রতীক। একসময় যমুনার বুক থেকে জন্ম নিয়ে এই নদী টাঙ্গাইলের সভ্যতার পথ খুলে দিয়েছিল। আজ সেই নদী মৃত্যুর প্রান্তে দাঁড়িয়ে।
কিন্তু আশার কথা, মানুষের ভালোবাসা ও সচেতনতার শক্তিই পারে এই নদীকে আবার জীবন্ত করে তুলতে। নদী মানে জীবন, নদী মানে সভ্যতা—লৌহজং সেই জীবনেরই অংশ, যাকে বাঁচানো মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্ব রক্ষা করা।
#লৌহজং_নদী #টাঙ্গাইল #নদী_রক্ষা #পরিবেশ #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 





















