ক্যাটাগরি–৫ মাত্রার হারিকেন ‘মেলিসা’ ৩০০ কিমি/ঘণ্টা বেগের বাতাস ও প্রায় পাঁচ মিটার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে জামাইকার দক্ষিণ–পশ্চিম উপকূলে আঘাত হেনে অবকাঠামো, কৃষি ও জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে। কৃষিভিত্তিক সেন্ট এলিজাবেথ প্যারিশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ঝড়টি হাইতি ও পূর্ব কিউবায় ধেয়ে গিয়ে ব্যাপক প্রাণহানি ও প্লাবন ঘটায়।
সারাংশে মূল খবর
- ৩০০ কিমি/ঘণ্টা বেগের বাতাসসহ ক্যাটাগরি–৫ ঝড় জামাইকার দক্ষিণ উপকূল তছনছ।
- ঐতিহাসিক শহর ব্ল্যাক রিভার প্রায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত; সেন্ট এলিজাবেথসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রাণহানি।
- দ্বীপের প্রায় তিন–চতুর্থাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন; স্কুল ও বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ।
- হাইতিতে অন্তত ২০ জনের মৃত্যু; কিউবায় ৭ লক্ষাধিক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে।
- অতি দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি—উত্তপ্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সতর্ক সংকেত।
- বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ও ক্যাটাস্ট্রফি বন্ড সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা—দ্রুত পুনরুদ্ধারে সহায়ক।
ঝড়ের আগমন ও আঘাত: কোথায়, কীভাবে
ঝড়টি রাজধানী কিংস্টনের পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে মূল আঘাত হানে দক্ষিণ–পশ্চিমের কৃষি–সমৃদ্ধ সেন্ট এলিজাবেথ প্যারিশে—যে অঞ্চল ২০২৪ সালের হারিকেন ‘বেরিল’-এর ক্ষতি থেকে তখনও পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। জলোচ্ছ্বাস উপকূলের সমুদ্রসৈকত ধুয়ে নেয়, বহু ঘরের ছাদ উড়ে যায়, আর উপকূলীয় জনপদের অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ्रস্ত হয়। দ্বীপের প্রাচীন উপনিবেশিক শহরগুলোর একটি ব্ল্যাক রিভার কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি
ব্ল্যাক রিভারের মেয়র রিচার্ড সলোমন জানান, শহরের জরুরি ত্রাণের কনটেইনার পর্যন্ত সাগরে ভেসে গেছে—দৃশ্যটি “বর্ণনার বাইরে”। ব্ল্যাক রিভার ও সেন্ট এলিজাবেথের বিভিন্ন স্থানে মরদেহ উদ্ধার হয়; দেশজুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা রিপোর্টের সময় ৯–এ পৌঁছায়, যা আরও বাড়তে পারে। সরকার জানায়, দ্বীপের প্রায় তিন–চতুর্থাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন; অধিকাংশ প্যারিশে সড়ক অবরুদ্ধ, গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে, বন্যা হয়েছে।
দৈনন্দিন জীবন: শিক্ষা ও ভ্রমণ
সব স্কুল ও বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়; ২৯ অক্টোবর থেকে ধাপে ধাপে বিমানবন্দর খুলতে শুরু করে। প্রায় ২৫ হাজার বিদেশি পর্যটক আটকে পড়লেও বড় হোটেলগুলো জানিয়েছে—অতিথিদের নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত করা গেছে।
হাইতি ও কিউবার পরিস্থিতি
ক্যারিবীয় সাগর পেরিয়ে হাইতিতে ‘মেলিসা’ অন্তত ২০ জনের প্রাণ কাড়ে, যাদের মধ্যে ১০ জন শিশু। পেতি–গোয়াভে এলাকায় আকস্মিক বন্যায় ডিগ নদীর তীরের অস্থায়ী বসতি ভেসে যায়; জ্যাকমেলে ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রধান সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়। জামাইকা ছাড়ার পর ঝড়টি উত্তরমুখে গিয়ে পূর্ব কিউবায় ক্যাটাগরি–৩ শক্তি নিয়ে আঘাত হানে—টানা বৃষ্টি ও বন্যায় শহর–বন্দর প্লাবিত হয় এবং ৭ লক্ষাধিক মানুষ সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়।

বিজ্ঞানভিত্তিক প্রেক্ষাপট: কেন এত ভয়াবহ?
মার্কিন ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টারের হিসাবে, এটি আটলান্টিক অববাহিকায় স্থলভাগে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড়গুলোর একটি—ক্যারিবীয় অঞ্চলে ২০১৯ সালের ‘ডোরিয়ান’-এর সমশক্তির। ‘মেলিসা’তে “অতি দ্রুত তীব্রতা বৃদ্ধি” লক্ষ্য করা যায়: ২৫–২৬ অক্টোবর ২৪ ঘণ্টায় বাতাসের বেগ ১১৩ কিমি/ঘণ্টা বাড়ে এবং ২৭ অক্টোবর ক্যাটাগরি–৫–এ উন্নীত হয়। ওই সময়ে ক্যারিবীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা মৌসুমী গড়ের চেয়ে প্রায় ১.৪°সে বেশি ছিল—জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন উষ্ণতার সম্ভাবনা কয়েকশ গুণ বেড়েছে বলে ধরা হয়।
অবকাঠামো ও সেবা–ব্যবস্থা
- বিদ্যুৎ: দ্বীপের প্রায় তিন–চতুর্থাংশ এলাকায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
- সড়ক: অধিকাংশ প্যারিশে গাছ–খুঁটি উপড়ে পড়ে সড়কযাত্রা ব্যাহত।
- শিক্ষা–পর্যটন: স্কুল বন্ধ, বিমানবন্দর ধীরে ধীরে চালু; বহু পর্যটক আটকা।
সরকারি প্রস্তুতি ও তহবিল
সেপ্টেম্বরে তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী অ্যান্ড্রু হোলনেস কোভিড–১৯ ও হারিকেন ‘বেরিল’–সহ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সঙ্কট–পরিচালনায় অভ্যস্ত। চলতি বছরের মার্চে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রায় ১৯২ মিলিয়ন ডলারের একটি কর্মসূচি অনুমোদন করে সরকার, যার অংশ ছিল দুর্যোগ–প্রস্তুতি জোরদার করা। ‘মেলিসা’র ধাক্কা সামাল দিতে এ অর্থ সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, বিশ্বব্যাংক–সমর্থিত ১৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্যাটাস্ট্রফি বন্ড সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে—যা দ্রুত নগদ সহায়তা দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক সহায়তা ও পুনরুদ্ধার
সরকার যুক্তরাষ্ট্র–সহ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে পুনরুদ্ধার–সহায়তা নিয়ে যোগাযোগ করছে। জামাইকানরা স্থিতিস্থাপকতার জন্য পরিচিত; তবে অধিকাংশ ঘরবাড়ি ও ব্যবসা বিমার আওতার বাইরে—তাই বিদেশি সাহায্য ও অংশীদারিত্ব অত্যন্ত জরুরি। সরকারি এক মন্ত্রীর ভাষায়, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও নিজেদের দৃঢ়তায় দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যেই কাজ চলছে।

‘মেলিসা’ শুধু একটি বিরল শক্তিশালী ঝড় নয়; উষ্ণতর সমুদ্র, দ্রুত তীব্রতাবৃদ্ধি ও উপকূলীয় ঝুঁকির ভবিষ্যৎ সংকেতও দিয়েছে। অবকাঠামোর সহনশীলতা বৃদ্ধি, আগাম সতর্কতা, দুর্যোগ–তহবিল ও জলবায়ু–সহনশীল পুনর্গঠনে এখনই বড় বিনিয়োগ জরুরি—নয়তো ক্যারিবীয় দ্বীপগুলো বারবার একই ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হবে।
#tags
#হারিকেন_মেলিসা #জামাইকা #হাইতি #কিউবা #ক্যারিবীয় #প্রাকৃতিক_দুর্যোগ #জলবায়ু_পরিবর্তন #দুর্যোগ_ব্যবস্থাপনা #বিশ্বব্যাংক #ক্যাটাস্ট্রফি_বন্ড #অবকাঠামো #পর্যটন #কৃষি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















