দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ট্রাম্প–শি বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সাময়িকভাবে বাণিজ্যযুদ্ধের উত্তাপ কমাতে কিছু ছাড় দিয়েছে। বিরলপদার্থ রপ্তানিতে এক বছরের জন্য চীনের নিয়ন্ত্রণ স্থগিত এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শুল্ক হ্রাসের ঘোষণায় দুই দেশের মধ্যে ‘কৌশলগত বিরতি’র ইঙ্গিত মিলেছে, যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটি এখনো স্থায়ী অগ্রগতি নয়।
মুখোমুখি আলোচনার প্রেক্ষাপট
২০১৯ সালের পর এই প্রথম মুখোমুখি হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। দক্ষিণ কোরিয়ার গিমহে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পশ্চিম ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি প্রায় দেড় ঘণ্টা স্থায়ী হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিরলপদার্থ, সোয়াবিন এবং ফেন্টানাইল সংক্রান্ত রপ্তানি ও শুল্ক নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলছিল।
চুক্তির মূল বিষয়বস্তু
চীন এক বছরের জন্য বিরলপদার্থ (Rare earth) রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ স্থগিত রাখবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি ও যুদ্ধবিমানসহ বিভিন্ন শিল্পে কাঁচামালের ঘাটতি কিছুটা কমবে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর আরোপিত শুল্ক ৫৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪৭ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছে—শর্ত ছিল চীন ফেন্টানাইল উৎপাদনে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করবে।
এ ছাড়া চীন “বড় পরিমাণে” সোয়াবিন কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সচিব জানিয়েছেন, চীন ডিসেম্বরের মধ্যে ১২ মিলিয়ন টন সোয়াবিন কিনতে পারে।

বৈঠকে Nvidia–র উন্নত ব্ল্যাকওয়েল (Blackwell) চিপ বিক্রির সম্ভাবনাও উঠে আসে। ট্রাম্প বলেন, আলোচনাটি প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও চীন বিষয়টি বিবেচনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ধারা ৩০১ অনুসন্ধান কার্যক্রমও এক বছরের জন্য স্থগিত করেছে, যা চীনের সামুদ্রিক ও জাহাজ নির্মাণ খাত নিয়ে চলছিল।
কৌশলগত বিরতি নাকি স্থায়ী অগ্রগতি
বিশ্লেষকরা একে “কৌশলগত বিরতি” হিসেবে দেখছেন, স্থায়ী সমাধান নয়। দ্য এশিয়া গ্রুপের চীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হান লিন বলেন, “মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা অক্ষুণ্ণ—প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ শৃঙ্খল ও নিরাপত্তা উদ্বেগ এখনো রয়ে গেছে। তবুও সাময়িক যুদ্ধবিরতি ভালো।”
ন্যাটিক্সিস ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিশিয়া গার্সিয়া-হেরেরো বলেন, “চীনের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কেবল স্থগিত, বাতিল নয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সোয়াবিন ও TikTok ইস্যুতে কিছু লাভ নিশ্চিত করেছে।”
বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুল্ক ১০ শতাংশ কমানো প্রতীকী সদিচ্ছা মাত্র, বড় কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন নয়।
আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও এই আলোচনার দিকনির্দেশনা নিয়ে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সিআইএসএএস প্রোগ্রামের পরিচালক গ্রেগরি পোলিং বলেন, “চীন–যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যে বড় পরিবর্তন হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রপ্তানিকারীরা চাপের মুখে পড়তে পারতো। এখন সেই ঝুঁকি কমেছে।”
লি কুয়ান ইউ পাবলিক পলিসি স্কুলের অধ্যাপক ড্যানি কোয়া বলেন, “চীন লাভ করলেও ‘আসিয়ান’ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আগে যে আশঙ্কা ছিল—চীনের সস্তা রপ্তানি তাদের চাপে ফেলবে—এখন তা কিছুটা প্রশমিত।”

নেতাদের ভাষণ ও প্রতীকী দৃশ্য
মিটিংয়ের শুরুতে হাসিমুখে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান দুই নেতা। শি বলেন, “আপনার সঙ্গে আবার দেখা পেয়ে আনন্দিত।” ট্রাম্পও প্রতিউত্তরে বলেন, “আপনাকেও দেখে ভালো লাগছে।”
শি তাঁর ভাষণে বলেন, “আমাদের দুই দেশের জাতীয় পরিস্থিতি আলাদা, তাই সব বিষয়ে একমত হওয়া সম্ভব নয়। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে মতবিরোধ স্বাভাবিক।”
তিনি আরও বলেন, “চীন–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নেতৃত্ব আমাদের হাতে। আমাদের সম্পর্কের জাহাজকে ঝড়ের মধ্যেও সঠিক পথে রাখতে হবে।”
শি জোর দিয়ে বলেন, চীনের উত্থান ও ট্রাম্পের ‘আমেরিকাকে আবার মহান করা’র নীতি পরস্পরের বিপরীতে নয়; বরং দুই দেশ একে অপরের সাফল্যে সহায়তা করতে পারে।
যদিও এই সম্মেলন নতুন যুগের সূচনা নয়, তবুও এটি উত্তেজনা প্রশমনে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। বড় কোনো আপস হয়নি, তবে উভয় দেশ আপাতত সংঘাত এড়িয়ে চলার কৌশল নিয়েছে। ২০২৬ সালে যদি এই ধারা বজায় থাকে, তবে দুই পরাশক্তির সম্পর্ক কিছুটা স্থিতিশীল হতে পারে।
#ট্রাম্প_শি_বৈঠক #চীন_যুক্তরাষ্ট্র_বাণিজ্যযুদ্ধ #বিরলপদার্থ #শুল্ক_নীতি #বিশ্ব_রাজনীতি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















