প্রলয়ের চিত্র: হোই আনে রাস্তাগুলো পরিণত খালে
ভিয়েতনামের মধ্যাঞ্চলে সপ্তাহজুড়ে টানা ভারী বৃষ্টিতে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৮ জন এখনো নিখোঁজ। হোই আনের ঐতিহ্যবাহী শহরসহ পাঁচটি প্রদেশে ১ লাখ ২৮ হাজারেরও বেশি বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার থু বোন নদীর পানি ৬০ বছরে সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছালে শহরের রাস্তাগুলো খালে পরিণত হয়।
প্রায় ১.৭ মিটার বৃষ্টি মাত্র ২৪ ঘণ্টায় পড়েছে বলে জানিয়েছে জাতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘরবাড়ি ও দোকানপাটের নিচতলা পানিতে ডুবে যাওয়ায় অনেকে নৌকা ও ভেলা ব্যবহার করে চলাচল করছেন।
মানুষের সংগ্রাম: “এমন বন্যা কখনো দেখিনি”
স্থানীয় বাসিন্দা ত্রান থি কি বলেন, “আমরা কয়েকদিন ধরে ইট দিয়ে ফার্নিচার উঁচুতে তুলেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়েছি।”
তার পরিবারের ফ্রিজ, রান্নাঘরের সরঞ্জাম ও কাঠের আসবাব প্রায় পুরোপুরি পানির নিচে। “জীবনে কখনও এমন ভয়াবহ বন্যা দেখিনি,” বলেন তিনি।
আরেক বাসিন্দা লে থি থি জানান, “সাধারণত তিন দিনেই পানি নেমে যায়, কিন্তু এবার এত দীর্ঘ ও তীব্র বন্যা আগে দেখিনি।”

অবকাঠামো বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতি
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্লাবিত এলাকার কোথাও কোথাও পানির গভীরতা তিন মিটার পর্যন্ত পৌঁছেছে। হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত বা ভূমিধসে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৫ হাজার হেক্টর ফসল ধ্বংস হয়েছে এবং ১৬ হাজারের বেশি গবাদিপশু মারা গেছে।
ডানাং ও কোয়াং নগাই প্রদেশের মধ্যবর্তী একটি পার্বত্য সড়ক ভূমিধসে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যা পরে আংশিকভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে। উদ্ধারকারীরা ড্রোনের মাধ্যমে আটকে পড়া প্রায় ৫০ জনের কাছে পানি ও শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়েছেন।
রেকর্ড ভাঙা নদীর উচ্চতা
থু বোন নদীর পানি বুধবার রাতে ৫.৬২ মিটার উচ্চতায় পৌঁছায়, যা ১৯৬৪ সালের ঐতিহাসিক রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে। আবহাওয়াবিদরা জানান, ডানাং ও হুয়ের কিছু এলাকায় পানি ধীরে নামতে শুরু করেছে, তবে এখনো ‘উদ্বেগজনক’ স্তরে রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ছাপ
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন প্রবল ও দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাত এবং বন্যা এখন আরও প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে।

ভিয়েতনামে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ঝড়, বন্যা ও ভূমিধসে ১৮৭ জনের মৃত্যু বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সরকারি হিসাবে, এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬১০ মিলিয়ন ডলার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি দুর্বল নগর পরিকল্পনা এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্যার প্রভাব আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ঝড়প্রবণ দেশ ভিয়েতনাম
বিশ্বের সবচেয়ে ঘন ঘন ক্রান্তীয় ঝড়প্রবণ অঞ্চলের একটি হলো ভিয়েতনাম। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশটি ভারী বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়। সাধারণত প্রতি বছর গড়ে ১০টি ঝড় বা ট্রপিক্যাল স্টর্ম ভিয়েতনামে আঘাত হানে, কিন্তু ২০২৫ সালে ইতোমধ্যেই ১২টি আঘাত হেনেছে।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ুবিজ্ঞানী নুগুয়েন ফুয়ং লোয়ান বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন ভিয়েতনামের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ঝড়ের সংখ্যা হয়তো কমবে, কিন্তু তাদের তীব্রতা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “ফলস্বরূপ ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি অনেক বেশি।”

ভৌগোলিক ঝুঁকি ও উপকূলীয় চাপ
৩,২০০ কিলোমিটার উপকূলরেখা এবং ২,৩০০ নদী নিয়ে গঠিত ভিয়েতনাম প্রাকৃতিকভাবেই বন্যাপ্রবণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় অঞ্চলে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।
ভূপ্রকৃতি ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে ভারী বৃষ্টির পর দেশটির অধিকাংশ এলাকায় পানি দ্রুত নামতে পারে না। ফলে জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত করে তোলে।
ভিয়েতনামের সাম্প্রতিক এই ভয়াবহ বন্যা শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্বল অবকাঠামো এবং অব্যবস্থাপনার এক তীব্র সতর্কবার্তা। দেশটির পরিবেশবিদ ও প্রশাসন এখন টেকসই পরিকল্পনার ওপর জোর দিচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন প্রলয়ঙ্কর পরিস্থিতি এড়ানো যায়।
#বন্যা #ভিয়েতনাম #জলবায়ুপরিবর্তন #হোইআন #প্রাকৃতিকদুর্যোগ #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 














