ভারতের দরিদ্রতম রাজ্য বিহারে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা চরমে। উন্নয়ন, বেকারত্ব ও জাতভিত্তিক রাজনীতি—এই তিনটি ইস্যু নিয়েই তৈরি হয়েছে জটিল প্রতিযোগিতা, যা শুধু রাজ্যের নয়, বরং ভারতের জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকও নির্ধারণ করবে।
গণতন্ত্রের নৃত্য নয়, যেন সংঘর্ষের মঞ্চ
বিহারে আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। কিন্তু নির্বাচনের প্রস্তুতি যেন গণতন্ত্রের উৎসব নয়, বরং এক রাজনৈতিক সংঘর্ষের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। ২০টিরও বেশি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে, প্রার্থীরা দল বদল করছেন, এবং একে অপরের বিরুদ্ধে “কালো কৌশল” ব্যবহারের অভিযোগ তুলছেন।
জাতীয় রাজনীতিতে নির্বাচনের প্রভাব
এই নির্বাচন শুধু রাজ্য নয়, জাতীয় রাজনীতির দিকেও প্রভাব ফেলবে। ফলাফল ঘোষিত হবে ১৪ নভেম্বর। এটি দেখাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-এর জনপ্রিয়তা কতটা টিকে আছে, এবং বিরোধীরা কতটা ঐক্যবদ্ধভাবে চ্যালেঞ্জ দিতে পারছে।
একই সঙ্গে, ভারতের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বিহারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যটির ১৩ কোটি মানুষের আয় বাড়ানো ছাড়া ভারতের “সমৃদ্ধ দেশ” হওয়ার লক্ষ্য পূরণ অসম্ভব। বর্তমানে বিহারের মাথাপিছু বার্ষিক আয় মাত্র ৬৬,০০০ রুপি (প্রায় ৮০০ ডলার), যা জাতীয় গড়ের এক-তৃতীয়াংশের চেয়েও কম।

নিতীশ কুমার ও উন্নয়নমুখী প্রচারণা
বিজেপি ও জনতা দল (ইউনাইটেড)-এর জোট সরকার বিহার পরিচালনা করছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন অভিজ্ঞ রাজনীতিক নিতীশ কুমার। গত দুই দশকের বেশির ভাগ সময় তিনিই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তার সরকার উন্নয়ন প্রকল্প, সড়ক নির্মাণ, বিদ্যুতায়ন এবং নারীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে প্রচারণা চালাচ্ছে।
মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে সাইকেল বিতরণ এবং উদ্যোক্তা নারীদের জন্য এককালীন ১০,০০০ রুপি অনুদান—এসব কর্মসূচি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চাঁপুরের এক নারী বলেন, “আমরা সবসময় নিতীশবাবুকেই ভোট দেব, কারণ তিনিই আমাদের জীবন বদলেছেন।”
অর্থনৈতিক অগ্রগতি, কিন্তু শঙ্কা রয়ে গেছে
৭৪ বছর বয়সী নিতীশ কুমার এখন আর তরুণ নেতা নন, এবং রাজ্যের অর্থনীতি নিয়েও বাড়ছে উদ্বেগ। গত এক দশকে বিহারের জিডিপি ৬০ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু এটি খুব নিম্ন ভিত্তি থেকে। প্রতিবেশী উত্তর প্রদেশসহ আরও কয়েকটি রাজ্য এর চেয়ে দ্রুত উন্নতি করেছে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো কর্মসংস্থানের অভাব। ভারতের বহু কারখানায় বিহারের শ্রমিক পাওয়া গেলেও রাজ্যটিতে নিজস্ব শিল্প কারখানার সংখ্যা দেশের মাত্র ১ শতাংশ। প্রায় অর্ধেক শ্রমিক কৃষিকাজে নিয়োজিত, যেখানে উৎপাদনশীলতা দেশের অন্য অংশের চেয়ে কম। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ—ভারতের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন।
চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিরোধীদের প্রচারণা
এই বেকারত্বের বিষয়টিকেই হাতিয়ার করেছে বিরোধী দলগুলো। তবে তাদের সমাধান বাস্তবসম্মত নয়। নিতীশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ৩৫ বছর বয়সী তেজস্বী যাদব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এলে ২০ মাসের মধ্যে এমন পর্যাপ্ত সরকারি চাকরি সৃষ্টি করবেন যাতে প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজন সরকারি কর্মচারী থাকবে। অর্থাৎ প্রতি মাসে এক মিলিয়নের বেশি নতুন পদ সৃষ্টি করতে হবে—যা বাস্তবে প্রায় অসম্ভব।
তবু, এই প্রতিশ্রুতি মানুষের মনে সাড়া ফেলেছে। কারণ বিহারে সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক স্থিতি ও বিয়ের বাজারে ‘সরকারি চাকরি’ এখনো সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সম্পদ। সাসারাম জেলার এক ছাত্র বলেন, “নারীরা সরকারি চাকরিজীবীকেই পছন্দ করেন,”—তিনি নিজেও সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জাতভিত্তিক রাজনীতি: পুরনো অভ্যাসে নতুন রূপ

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান নিয়ে বিতর্কের পরিবর্তে শাসক ও বিরোধী দুই দলই আবার জাতভিত্তিক রাজনীতিতে মনোযোগ দিচ্ছে। বিহারে জাত ব্যবস্থা গভীরভাবে প্রোথিত। গ্রামগুলো এখনো জাত অনুসারে বিভক্ত, যেখানে উচ্চবর্ণের মানুষ তুলনামূলকভাবে বেশি শিক্ষিত ও সম্পদশালী।
রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থীদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেয় তাদের জাতভিত্তিক আনুগত্যের ওপর ভিত্তি করে, নয় তাদের যোগ্যতা বা নীতির কারণে। সাম্প্রতিক সময়ে দলগুলো “সংরক্ষণ” ব্যবস্থার বিস্তারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে—যেখানে নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
জাতীয় রাজনীতিতে জাত গণনা ও ভবিষ্যৎ দিক
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর বিজেপি একটি জাতীয় জাত গণনার ঘোষণা দিয়েছে। বিহার ইতিমধ্যে ২০২৩ সালে নিজস্ব জাত গণনা সম্পন্ন করেছে। এই তথ্য ভবিষ্যতে সংরক্ষণ ব্যবস্থার পরিধি বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
উন্নয়নই প্রকৃত সমাধান
বিহারের উন্নয়ন ভারতের ভবিষ্যতের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। যদি রাজনীতিবিদরা অর্থনীতির উন্নয়ন নিয়েই বেশি সময় ব্যয় করতেন, আর কেবল জাতভিত্তিক সুবিধা বণ্টনের লড়াইয়ে না জড়াতেন—তাহলে হয়তো বিহারই হতে পারত ভারতের সম্ভাবনার প্রকৃত প্রতীক।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















