বাংলাদেশে অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নয় এমন নির্বাচনের পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ ও ইউএনডিপিকে নির্বাচনি সহযোগিতা স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। শনিবার ঢাকায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর প্রতিনিধি স্টেফান লিলার বরাবর পাঠানো চিঠিতে দলটি এ দাবি জানায়। দলের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল-এর মাধ্যমে।
চিঠির মূল দাবি
চিঠিতে বলা হয়েছে, যদি নির্বাচন অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক না থাকে, ততক্ষণ জাতিসংঘ এবং ইউএনডিপি যেন নির্বাচনি সহযোগিতা স্থগিত রাখে। একই সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে জাতীয় সংলাপ ও সমঝোতা নিশ্চিত করতে এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসন রক্ষা করতে বলা হয়েছে।
উদ্বেগের কারণ
চিঠির শিরোনামেই বলা হয়েছে—‘বাংলাদেশে ইউএনডিপির নির্বাচনি সহযোগিতা এবং জাতিসংঘ সনদের নিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও মৌলিক অধিকারের মূলনীতি লঙ্ঘন’। আওয়ামী লীগের শঙ্কা, ব্যালট প্রজেক্টসহ চলমান নির্বাচনি সহায়তা অব্যাহত রাখলে তা জাতিসংঘের নীতিমালা ও ইউএনডিপির ম্যান্ডেট লঙ্ঘনের ঝুঁকি তৈরি করবে। দলটি জানায় যে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে ইউএনডিপির সম্পৃক্ততা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

বিতর্কিত নির্বাচন ও আস্থা সংকট
চিঠিটি এমন সময় এসেছে যখন আওয়ামী লীগ পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিল। ২০০৮ সালে বড় জয় পেরিয়ে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়; এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাদের শাসনামলে।
২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি সহ বেশিরভাগ বিরোধী দল অংশ না নেওয়ায় ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়—যা ‘বিনা ভোটের সংসদ’ নামে পরিচিত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে; সেটি জনসমক্ষে ‘নিশিরাতের নির্বাচন’ নামে উল্লেখিত হয়েছে। ২০২৪ সালে অংশগ্রহণ দেখাতে কিছু আসন ছেঁটে দেওয়া হলেও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল আওয়ামী লীগের প্রচারিত প্রার্থী বনাম বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে—যা অনেকের কাছে ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচন হিসেবে পরিচিত।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ও মামলা-প্রক্রিয়া
গত ডিসেম্বর হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু অনুচ্ছেদ বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছে। রায়ে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ শাসিত সময়ে পরিচালিত তিনটি নির্বাচনে অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, ফলে জনগণের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ঘটনায় বিএনপি ওই নির্বাচনগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করেছে, যেখানে শেখ হাসিনা ও সাবেক নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা অভিযুক্ত হয়েছেন।
ইউএনডিপির ভূমিকা পুনর্মূল্যায়নের অনুরোধ
আওয়ামী লীগ চিঠিতে বলেছে, শক্তিশালী নির্বাচনি প্রতিষ্ঠান গড়া জরুরি — তবে সেটি মৌলিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হতে হবে। দলটির দাবি, বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ দমনমূলক; হাজারো রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক ও সাধারণ নাগরিক কারাবন্দি বা হুমকির মুখে রয়েছে এবং রাজনৈতিক সংলাপের সুযোগ সীমিত। পাশাপাশি তারা ধর্মীয় উগ্রবাদী প্রবণতার বাড়াবাড়ি দেশের উদার মূল্যবোধ ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করেছে।
গোষ্ঠীগত বঞ্চনা ও নির্যাতন রোধে ইউএনডিপিকে তাদের নির্বাচনি সহায়তা পুনর্মূল্যায়ন করার অনুরোধ করেছে দলটি। তাদের মতে, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে সংলাপ, সমঝোতা, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এবং সকল দলের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

নিষেধাজ্ঞা ও বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গত মে মাসে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। পরে নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন স্থগিত করার ফলে ছয় মেয়াদে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা দলটি বর্তমানে নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রতিহত হচ্ছে।
অতীতে দলের বক্তব্য ছিল, ‘নির্বাচন মানেই শুধু দল নয়, জনগণের অংশগ্রহণ।’ এই ধারণাটিকে জাতিসংঘের বিদায়ী আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইসও উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, “অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন মানে হলো—সমাজের প্রতিটি অংশ, নারী, তরুণ, সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সম্প্রদায় যেন ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারে; এটি কোনো এক রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়।”
জাতিসংঘ, ইউএনডিপি, আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ নির্বাচন, রাজনীতি, শেখ হাসিনা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















