উত্তর আফগানিস্তানে ভয়াবহ কম্পন
সোমবার ভোররাতের আগে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে ৬.৩ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে অন্তত ২০ জন নিহত এবং ৬৪০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আহতদের মধ্যে ২৫ জনের অবস্থা গুরুতর। ভূমিকম্পে ঐতিহাসিক নীল মসজিদসহ বহু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ধ্বংসস্তূপে মরদেহ উদ্ধার
ভূমিকম্পের কেন্দ্রের কাছাকাছি খুলম শহরে স্থানীয়রা হাত ও কোদাল ব্যবহার করে ধসে পড়া মাটির ঘরগুলোর ধ্বংসাবশেষে জীবিতদের খুঁজছেন। স্থানীয় বাসিন্দা আহমদ জিয়া জানান, ধূলায়, চারপাশ ভরে গেছে। তিনি বলেন, “আমরা ধ্বংসস্তূপ থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করেছি। আজই তাদের দাফন করা হবে।”

ফেটে গেছে ঐতিহাসিক নীল মসজিদের দেয়াল
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওতে দেখা গেছে, মাজার-ই-শরিফে অবস্থিত শতাব্দীপ্রাচীন নীল মসজিদের দেয়ালের কিছু ইট পড়ে গেছে, তবে মূল কাঠামো অক্ষত রয়েছে। এই ধর্মীয় নিদর্শনটি আফগানিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেখানে ধর্মীয় উৎসবে হাজারো মানুষ সমবেত হন।
দুর্বল অবকাঠামো ও চরম দুরবস্থা
দারিদ্র্যপীড়িত আফগানিস্তান বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় হিমশিম খায়, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অধিকাংশ ভবন নিচু কাঠামোর এবং কংক্রিট বা ইট দিয়ে তৈরি। গ্রামীণ এলাকায় ঘরগুলো সাধারণত কাঁচা মাটির ইট ও কাঠ দিয়ে নির্মিত, যা ভূমিকম্পে সহজেই ধসে পড়ে।
গত আগস্টেও, পূর্ব আফগানিস্তানে ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্পে ২,২০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
কেন্দ্রস্থল ও ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (USGS) জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল খুলম শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে ২২ কিলোমিটার দূরে এবং গভীরতা ছিল ২৮ কিলোমিটার। আফগানিস্তানের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের উপপ্রবক্তা ক্বারি তাজ মোহাম্মদ হেমাত জানান, ভূমিকম্পে বলখ, সামানগান, সার-ই-পুল ও কুন্দুজ প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ২০ জন নিহত এবং ৬৪৩ জন আহত হয়েছেন।

ধ্বংস ও হতাহতের চিত্র
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শরাফত জামান জানান, আহতদের অধিকাংশকেই বলখ ও সামানগান প্রদেশের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। উদ্ধারকাজ চলছে এবং নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
বাদাখশান প্রদেশের শাহর-ই-বোজোরগ জেলায় এক গ্রামে প্রায় ৮০০টি বাড়ি আংশিক বা সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রাদেশিক পুলিশ মুখপাত্র ইহসানুল্লাহ কামগার। দূরবর্তী এলাকায় ইন্টারনেট না থাকায় সঠিক ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা এখনও নির্ধারণ করা যায়নি।
স্থানীয়দের আর্থিক ক্ষতি ও সহায়তা কার্যক্রম
খুলমের আরেক বাসিন্দা আবদুল মুবিন বলেন, “ভূমিকম্পে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষ প্রচুর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেকের ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েছে।”
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উদ্ধার ও জরুরি সহায়তা দল বলখ ও সামানগানে পৌঁছেছে এবং আহতদের হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে।
সরকারের পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
তালেবান সরকারের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ ‘এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) জানিয়েছেন, সরকারি সংস্থাগুলো সক্রিয়ভাবে ত্রাণ তৎপরতায় কাজ করছে। ভূমিকম্পের প্রভাব রাজধানী কাবুল ও আশপাশের প্রদেশগুলোতেও অনুভূত হয়।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, কাবুল-মাজার-ই-শরিফ মহাসড়কের একটি অংশে পাথরধসে রাস্তা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেলেও, পরে তা খুলে দেওয়া হয়।

পাকিস্তান ও জাতিসংঘের সহমর্মিতা
ইসলামাবাদ থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি আফগানিস্তানে প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন এবং বলেন, পাকিস্তান এই কঠিন সময়ে আফগান জনগণের পাশে রয়েছে।
জাতিসংঘ আফগানিস্তানে জানিয়েছে, তাদের দল ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছে সহায়তা কার্যক্রম শুরু করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পাশে আছি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করব।”
অতীতের ভূমিকম্পের ভয়াবহ স্মৃতি
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে ৬.৩ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্পে অন্তত ৪,০০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যার পরও আফগান জনগণ এখনও পুনর্গঠনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এবারও একই মাত্রার এই নতুন ভূমিকম্প দেশটির উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ মানবিক সংকটের আশঙ্কা তৈরি করেছে।
#আফগানিস্তান #ভূমিকম্প #নীল_মসজিদ #বলখ #কাবুল #আন্তর্জাতিক_সংবাদ #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















