হংকং সম্মেলনে বিশ্ব আর্থিক নেতাদের সতর্কবার্তা
হংকংয়ে অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক আর্থিক সম্মেলনে শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকার ও বিনিয়োগ কর্মকর্তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সংশ্লিষ্ট ডেটা সেন্টারে অতি বিনিয়োগ ও মূলধনের ভুল বণ্টন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, বর্তমানে বাজারে ‘অযৌক্তিক উচ্ছ্বাস’ তৈরি হয়েছে, যা ভবিষ্যতে একটি বড় ধসের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ডেভিড সলোমন বলেন, “প্রযুক্তি খাতের মূল্যায়ন ইতিমধ্যেই চূড়ায় পৌঁছেছে।” তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, আগামী ১২ থেকে ২৪ মাসে শেয়ারবাজারে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত পতন ঘটতে পারে।
এআই-নির্ভর প্রযুক্তি ও বাজারের উচ্ছ্বাস
সলোমন জানান, এআই প্রযুক্তির প্রয়োগে বিপুল মূল্য সৃষ্টি হচ্ছে, তবে বিনিয়োগের গতি অনেক সময় প্রযুক্তির প্রকৃত অগ্রগতির চেয়ে দ্রুত হয়। ফলে, এই খাতে যেমন সফলতা আসবে, তেমনি অনেক কোম্পানিও ক্ষতির মুখ দেখবে।
এই সতর্কতা এমন এক সময়ে এসেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার গত এক বছরে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর দৌড়ে ঐতিহাসিক উল্লম্ফন দেখেছে। চিপ নির্মাতা এনভিডিয়া সম্প্রতি বিশ্বের প্রথম কোম্পানি হিসেবে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যে পৌঁছেছে, কারণ বিনিয়োগকারীরা ডেটা সেন্টার নির্মাণে শত শত বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতিতে ঝুঁকেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহে বাজারে অস্থিরতা বাড়ছে — মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকগুলোর সতর্কবার্তার পর বড় পতন দেখা দেয়।

এশীয় বাজারেও ধসের প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তিখাতে বিক্রির ধাক্কা এশীয় বাজারেও ছড়িয়ে পড়ে। হংকংয়ের হ্যাং সেং সূচক এক পর্যায়ে ২% পর্যন্ত নিচে নামে, পরে সামান্য ঘুরে দাঁড়ায়। জাপানের নিক্কেই সূচক সকালে ৪.৭% বা প্রায় ২,৪০০ পয়েন্ট পর্যন্ত পতনের পর দিনশেষে ২.৫% নিচে বন্ধ হয়। প্রযুক্তি জায়ান্ট সফটব্যাংক গ্রুপের শেয়ার ১০% ও চিপ যন্ত্র প্রস্তুতকারী অ্যাডভানটেস্টের শেয়ার ৬% পড়ে যায়।
অক্টোবর মাসে নিক্কেই সূচক ১৭% বৃদ্ধি পেয়ে ৫২,০০০ পয়েন্ট অতিক্রম করেছিল, যা হঠাৎ পতনের পটভূমি তৈরি করে। ওকাসান সিকিউরিটিজের প্রধান কৌশলবিদ ফুমিও মাতসুমতো বলেন, “দ্রুত উত্থানের কারণে বিনিয়োগকারীদের মনে অতিরিক্ত উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।”
দক্ষিণ কোরিয়ার কোসপি সূচক ৩% কমে যায়, প্রধানত এসকে হাইনিক্স ও স্যামসাং ইলেকট্রনিকসের পতনে। তাইওয়ানের তাইএক্স সূচকও নিচে নামে, যেখানে টিএসএমসি প্রায় ৩% হারায়।
বিশাল বিনিয়োগ ও ঋণের চাপ
ম্যাককিনসি অ্যান্ড কোম্পানির এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে কোম্পানিগুলো এআই-সম্পর্কিত ডেটা সেন্টার নির্মাণে প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। গত দশকে বিশ্বের শীর্ষ ১,৩০০ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ঋণ চারগুণ বেড়েছে — মূলত জেনারেটিভ এআই ও ডেটা সেন্টারের চাহিদা মেটাতে।

হংকং মুদ্রা কর্তৃপক্ষের আয়োজিত তিনদিনব্যাপী এই সম্মেলনে বিভিন্ন আলোচনায় বিনিয়োগ ঝুঁকি ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ে সতর্কতা উঠে আসে।
‘অতিরিক্ত উত্তেজনা ও মূলধন অপচয়’ — বিশেষজ্ঞদের অভিমত
ইউএস প্রাইভেট ইক্যুইটি কোম্পানি জেনারেল আটলান্টিকের চেয়ারম্যান ও সিইও উইলিয়াম ফোর্ড বলেন, “অন্যান্য প্রযুক্তির মতো এখানেও মূলধন অপচয়, অতিমূল্যায়ন ও অযৌক্তিক উত্তেজনা দেখা যাবে।” তাঁর মতে, এই খাত দীর্ঘমেয়াদে নতুন শিল্প ও উদ্ভাবনের জন্ম দেবে, তবে এই ফলাফল পেতে সময় লাগবে অন্তত ২০ বছর।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাসেট ম্যানেজার ক্যাপিটাল গ্রুপের সিইও মাইক গিটলিন বলেন, “আমরা প্রায়ই স্বল্পমেয়াদে প্রভাবকে অতিমূল্যায়ন করি এবং দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাবকে অবমূল্যায়ন করি।” তিনি আরও যোগ করেন, “বর্তমান বাজারমূল্যায়ন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ভবিষ্যতের প্রত্যাশাগুলো ইতিমধ্যেই দামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।”
ডিফাই ও স্টেবলকয়েন ঝুঁকি নিয়ে এইচএসবিসি প্রধানের সতর্কতা
এইচএসবিসি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী জর্জ এলহেদারি বিকেন্দ্রীকৃত অর্থব্যবস্থা (ডিফাই) সম্পর্কেও সতর্কবার্তা দেন। তিনি বলেন, “স্টেবলকয়েন বাজার এখনো সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত। এটি এমন এক বিচ্ছিন্ন ক্ষেত্র, যেখানে নিয়ন্ত্রণমূলক নিয়মাবলি কেবল সুপারিশ মাত্র।”
এলহেদারি বলেন, “এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে ভোক্তারা ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, কারণ তখন নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের সহায়তায় থাকবে না।”
হংকংয়ের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই সরকারি অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্টেবলকয়েন ইস্যুর পরিকল্পনা করছে। অপরদিকে, সিঙ্গাপুর গত অক্টোবরেই নিজেদের মুদ্রার সঙ্গে সংযুক্ত একটি স্টেবলকয়েন চালু করেছে।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস জানায়, চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো হংকংয়ে স্টেবলকয়েন লাইসেন্সের আবেদন আপাতত স্থগিত করেছে, কারণ বেইজিং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
বিশ্বজুড়ে এআই-নির্ভর ডেটা সেন্টারে বিনিয়োগের প্রবাহ এখনো তীব্র, তবে হংকং সম্মেলনের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অতি দ্রুত বিনিয়োগ প্রবণতা যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে প্রযুক্তি খাতে নতুন এক বুদবুদের সৃষ্টি হতে পারে — যার পরিণতি হতে পারে বৈশ্বিক বাজারে আরেকটি বড় ধস।
#এআই #ডেটাসেন্টার #হংকংসম্মেলন #বাজারধস #প্রযুক্তিবিনিয়োগ #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















