০৬:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫
গোপালগঞ্জ সংঘর্ষে এনসিপি ও আওয়ামী লীগ দুই পক্ষই দায়ী- তদন্ত কমিটি ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে: নতুন করে আরও ৬ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি প্রায় ১২০০ রোগী ঘোড়া-থিমের ফুকুবুকুরো: জাপানে ২০২৬ নববর্ষে পণ্য নয়, অভিজ্ঞতাই মূল টান ডকুমেন্টারি আবার আলোয় আনতে নিউইয়র্কে ভ্যারাইটির ‘ডক ড্রিমস লাইভ’ আমাজনের বেলেং-এ শুরু হলো কপ৩০, যুক্তরাষ্ট্র নেই আলোচনার টেবিলে সপ্তাহের শুরুতেই শেয়ারবাজারে ধস: ডিএসই সূচক ৬৮ পয়েন্ট ও সিএসই ৩৫ পয়েন্ট কমেছে ২০২৫ সালের গিফট গাইডে এআই ও ওয়্যারেবলকে শীর্ষে তুলল এনগ্যাজেট তাইওয়ান প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে চীনা কূটনীতিককে ডেকে পাঠাল টোকিও ব্রিটেনকে বিনিয়োগকারীদের বার্তা: একটু আশাবাদী হোন ভারতের অদ্ভুত স্থিতিশীলতা: অস্থির প্রতিবেশে শান্ত শক্তি 

সময়ের পরীক্ষায় অটল বন্ধন — ভারত-রাশিয়া কূটনীতির নতুন দিগন্ত

দুই দেশের সম্পর্ক: স্থায়ী বিশ্বাস ও কৌশলগত সহযোগিতা

রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত দেনিস আলিপভ জানিয়েছেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখেও ভারত ও রাশিয়া পারস্পরিক অর্থনৈতিক লেনদেনের ব্যবস্থা আরও উন্নত করছে। রুশ ব্যাংকগুলো নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং ভারতীয় ব্যাংকগুলোও ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা’র ঝুঁকি কমানোর কৌশল রপ্ত করেছে।

বর্তমানে দুই দেশ প্রায় ৯০ শতাংশ বাণিজ্য জাতীয় ও বিকল্প মুদ্রায় নিষ্পত্তি করছে। রাষ্ট্রদূত জানান, বাণিজ্যিক লেনদেনের সরাসরি অর্থপ্রবাহের কাঠামো তৈরি হয়েছে এবং উভয় দেশ এখন স্বাধীন আর্থিক ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।


পুতিনের সফরকে ঘিরে প্রধান লক্ষ্য

আগামী মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সফর উপলক্ষে আলিপভ বলেন, ভারত-রাশিয়া কৌশলগত অংশীদারিত্ব ইতিমধ্যে ২৫ বছর পূর্ণ করেছে এবং এটি এখন বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে পরিণত হয়েছে।

তিনি জানান, বার্ষিক শীর্ষ বৈঠকে পরমাণু শক্তি, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা ও জনগণের পারস্পরিক সম্পর্কসহ দীর্ঘদিনের সহযোগিতার সব খাত পর্যালোচনা করা হবে।

বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে। ২০২২ সালের পর থেকে দুই দেশের বাণিজ্য ছয় গুণ বেড়ে ৭০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যার মধ্যে ভারতীয় জ্বালানি নিরাপত্তায় রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে—ভারতের অপরিশোধিত তেলের এক-তৃতীয়াংশই এখন রাশিয়া থেকে আসে।

রাশিয়া ও ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে বাণিজ্যকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। এজন্য উভয় দেশ বিকল্প লজিস্টিক রুট যেমন—ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর (INSTC)চেন্নাই-ভ্লাদিভোস্তক রুট এবং নর্দার্ন সি রুট—এর উন্নয়নে কাজ করছে। একইসঙ্গে শ্রমবাজার, বিনিয়োগ ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) স্থাপনের উদ্যোগও চলছে।


ভবিষ্যতমুখী সম্পর্কের অনন্য দৃষ্টান্ত

রাশিয়া ও ভারতের সম্পর্ক ১৯৪৭ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই “সময়-পরীক্ষিত” ও “বিশ্বাসযোগ্য” হিসেবে পরিচিত। এই সম্পর্ক কেবল ঐতিহ্যের নয়, বরং সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থের প্রতিফলন।

রাষ্ট্রদূত বলেন, এই অংশীদারিত্ব একাধিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও অটল থেকেছে এবং ক্রমে আরও দৃঢ় হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর শিল্পায়ন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, মহাকাশ গবেষণা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মতো ইতিহাস এই সম্পর্ককে আজকের অবস্থানে এনেছে।

রাশিয়া ও ভারতের বিশেষ ও প্রাধান্যপূর্ণ কৌশলগত অংশীদারিত্বের ১৫ বছর পূর্তি ডিসেম্বর মাসে উদ্‌যাপিত হবে। রাশিয়ার জন্য এই মর্যাদা কেবল ভারতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো একসঙ্গে কাজ করে একটি ন্যায়ভিত্তিক বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতির ওপর দাঁড়াবে।”


পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে রাশিয়া “অবৈধ রাজনৈতিক চাপের হাতিয়ার” হিসেবে দেখছে। আলিপভ জানান, এই নিষেধাজ্ঞা সাধারণ মানুষের জীবন ও অর্থনৈতিক প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় যোগ দেয়নি, তবে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাভিত্তিক কিছু ভারতীয় প্রতিষ্ঠান সতর্কভাবে রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করছে।

বর্তমানে দুই দেশ বিকল্প পেমেন্ট সিস্টেম তৈরি করেছে, যেখানে জাতীয় মুদ্রা ব্যবহারের হার ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। রাশিয়া-ভারত ব্যাংকিং সহযোগিতা এখন আরও নিরাপদ, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বাইরে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে।


ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ে ভারতের ভূমিকা

আলিপভ বলেন, “ভারতের কণ্ঠ এখন উদীয়মান বহুমেরু বিশ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” রাশিয়া প্রশংসা করছে ভারতের “সন্তুলিত ও নীতিনিষ্ঠ” অবস্থানকে, যা ইউক্রেন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে সহায়ক।

তিনি উল্লেখ করেন, ভারত নিজেও ১৯৯৮ সালের পারমাণবিক পরীক্ষার পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছিল। তাই রাশিয়া আশা করে, ভারত অবৈধ নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা অব্যাহত রাখবে।

রাষ্ট্রদূতের ভাষায়, “চাপ প্রয়োগ কখনও কার্যকর সমাধান আনে না, বরং ক্ষোভ বাড়ায়। প্রেসিডেন্ট পুতিন যেমন বলেছেন—কোনও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন দেশ কখনও চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নেয় না।”


পরমাণু সহযোগিতা: কুদানকুলাম থেকে ভবিষ্যৎ প্রকল্প

তামিলনাড়ুর কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সফল বাস্তবায়নকে আলিপভ “দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মাইলফলক” বলে বর্ণনা করেছেন। ছয়টি ব্লকের মধ্যে দুটি ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

রাশিয়া এখন ছোট ও মডুলার রিঅ্যাক্টর (SMR) নির্মাণে ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রকল্পে আগ্রহী। ভারতের ২০৪৭ সালের মধ্যে ১০০ গিগাওয়াট পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।


প্রতিরক্ষা খাতে গভীর অংশীদারিত্ব

ভারতীয় সেনাবাহিনীর বহু প্রজন্ম রুশ তৈরি অস্ত্রের ওপর আস্থা রেখেছে। আলিপভ বলেন, “রুশ অস্ত্র ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি।”

ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—দুই দেশ যৌথভাবে সফল প্রকল্প চালিয়ে আসছে। এছাড়া উত্তর প্রদেশে একে-২০০ সিরিজ রাইফেল উৎপাদনও এখন স্থানীয় পর্যায়ে হচ্ছে।

রাশিয়া ভবিষ্যতে ভারতকে Su-57 পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির প্রযুক্তিও সরবরাহ করতে প্রস্তুত, যা ভারতের নিজস্ব AMCA প্রকল্পকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

রাশিয়ার অবদান শুধু প্রতিরক্ষা নয়, বেসামরিক বিমান শিল্পেও সম্প্রসারিত হচ্ছে। সম্প্রতি হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড (HAL) ও রাশিয়ার ইউনাইটেড এয়ারক্রাফট করপোরেশন (UAC)–এর মধ্যে Sukhoi SJ-100 যাত্রীবিমান তৈরির বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে ভারত নিজ দেশে বিমান উৎপাদনের পাশাপাশি আঞ্চলিক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠবে।


ভারতীয় নাগরিকদের রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিষয়

রাষ্ট্রদূত স্বীকার করেন, কিছু ভারতীয় নাগরিক রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে—এটি দুই দেশের জন্যই উদ্বেগের বিষয়।

তিনি স্পষ্ট করে বলেন, রুশ সেনাবাহিনী কোনও ভারতীয় নাগরিককে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ করে না; যারা যোগ দিয়েছে, তারা নিজের ইচ্ছাতেই করেছে।

ভারত সরকার ইতিমধ্যে নাগরিকদের সতর্ক করেছে যেন তারা প্রতারণামূলক নিয়োগ সংস্থার ফাঁদে না পড়ে। এ বিষয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করছে।


ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক আজও অতীতের বিশ্বাস ও সহযোগিতার ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। পারমাণবিক শক্তি, প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও জ্বালানি নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রে এই অংশীদারিত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আরও গভীর ও বহুমাত্রিক হয়ে উঠছে।


#ভারত_রাশিয়া #কূটনীতি #পুতিন #রাশিয়া #ভারত #অর্থনীতি #প্রতিরক্ষা #জ্বালানি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

গোপালগঞ্জ সংঘর্ষে এনসিপি ও আওয়ামী লীগ দুই পক্ষই দায়ী- তদন্ত কমিটি

সময়ের পরীক্ষায় অটল বন্ধন — ভারত-রাশিয়া কূটনীতির নতুন দিগন্ত

১২:৪২:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫

দুই দেশের সম্পর্ক: স্থায়ী বিশ্বাস ও কৌশলগত সহযোগিতা

রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত দেনিস আলিপভ জানিয়েছেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখেও ভারত ও রাশিয়া পারস্পরিক অর্থনৈতিক লেনদেনের ব্যবস্থা আরও উন্নত করছে। রুশ ব্যাংকগুলো নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং ভারতীয় ব্যাংকগুলোও ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা’র ঝুঁকি কমানোর কৌশল রপ্ত করেছে।

বর্তমানে দুই দেশ প্রায় ৯০ শতাংশ বাণিজ্য জাতীয় ও বিকল্প মুদ্রায় নিষ্পত্তি করছে। রাষ্ট্রদূত জানান, বাণিজ্যিক লেনদেনের সরাসরি অর্থপ্রবাহের কাঠামো তৈরি হয়েছে এবং উভয় দেশ এখন স্বাধীন আর্থিক ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।


পুতিনের সফরকে ঘিরে প্রধান লক্ষ্য

আগামী মাসে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সফর উপলক্ষে আলিপভ বলেন, ভারত-রাশিয়া কৌশলগত অংশীদারিত্ব ইতিমধ্যে ২৫ বছর পূর্ণ করেছে এবং এটি এখন বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে পরিণত হয়েছে।

তিনি জানান, বার্ষিক শীর্ষ বৈঠকে পরমাণু শক্তি, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা ও জনগণের পারস্পরিক সম্পর্কসহ দীর্ঘদিনের সহযোগিতার সব খাত পর্যালোচনা করা হবে।

বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে। ২০২২ সালের পর থেকে দুই দেশের বাণিজ্য ছয় গুণ বেড়ে ৭০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যার মধ্যে ভারতীয় জ্বালানি নিরাপত্তায় রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে—ভারতের অপরিশোধিত তেলের এক-তৃতীয়াংশই এখন রাশিয়া থেকে আসে।

রাশিয়া ও ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে বাণিজ্যকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। এজন্য উভয় দেশ বিকল্প লজিস্টিক রুট যেমন—ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর (INSTC)চেন্নাই-ভ্লাদিভোস্তক রুট এবং নর্দার্ন সি রুট—এর উন্নয়নে কাজ করছে। একইসঙ্গে শ্রমবাজার, বিনিয়োগ ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) স্থাপনের উদ্যোগও চলছে।


ভবিষ্যতমুখী সম্পর্কের অনন্য দৃষ্টান্ত

রাশিয়া ও ভারতের সম্পর্ক ১৯৪৭ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই “সময়-পরীক্ষিত” ও “বিশ্বাসযোগ্য” হিসেবে পরিচিত। এই সম্পর্ক কেবল ঐতিহ্যের নয়, বরং সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্মান ও স্বার্থের প্রতিফলন।

রাষ্ট্রদূত বলেন, এই অংশীদারিত্ব একাধিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও অটল থেকেছে এবং ক্রমে আরও দৃঢ় হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর শিল্পায়ন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, মহাকাশ গবেষণা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মতো ইতিহাস এই সম্পর্ককে আজকের অবস্থানে এনেছে।

রাশিয়া ও ভারতের বিশেষ ও প্রাধান্যপূর্ণ কৌশলগত অংশীদারিত্বের ১৫ বছর পূর্তি ডিসেম্বর মাসে উদ্‌যাপিত হবে। রাশিয়ার জন্য এই মর্যাদা কেবল ভারতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো একসঙ্গে কাজ করে একটি ন্যায়ভিত্তিক বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতির ওপর দাঁড়াবে।”


পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে রাশিয়া “অবৈধ রাজনৈতিক চাপের হাতিয়ার” হিসেবে দেখছে। আলিপভ জানান, এই নিষেধাজ্ঞা সাধারণ মানুষের জীবন ও অর্থনৈতিক প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় যোগ দেয়নি, তবে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাভিত্তিক কিছু ভারতীয় প্রতিষ্ঠান সতর্কভাবে রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করছে।

বর্তমানে দুই দেশ বিকল্প পেমেন্ট সিস্টেম তৈরি করেছে, যেখানে জাতীয় মুদ্রা ব্যবহারের হার ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। রাশিয়া-ভারত ব্যাংকিং সহযোগিতা এখন আরও নিরাপদ, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বাইরে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে।


ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ে ভারতের ভূমিকা

আলিপভ বলেন, “ভারতের কণ্ঠ এখন উদীয়মান বহুমেরু বিশ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” রাশিয়া প্রশংসা করছে ভারতের “সন্তুলিত ও নীতিনিষ্ঠ” অবস্থানকে, যা ইউক্রেন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে সহায়ক।

তিনি উল্লেখ করেন, ভারত নিজেও ১৯৯৮ সালের পারমাণবিক পরীক্ষার পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছিল। তাই রাশিয়া আশা করে, ভারত অবৈধ নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা অব্যাহত রাখবে।

রাষ্ট্রদূতের ভাষায়, “চাপ প্রয়োগ কখনও কার্যকর সমাধান আনে না, বরং ক্ষোভ বাড়ায়। প্রেসিডেন্ট পুতিন যেমন বলেছেন—কোনও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন দেশ কখনও চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নেয় না।”


পরমাণু সহযোগিতা: কুদানকুলাম থেকে ভবিষ্যৎ প্রকল্প

তামিলনাড়ুর কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সফল বাস্তবায়নকে আলিপভ “দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মাইলফলক” বলে বর্ণনা করেছেন। ছয়টি ব্লকের মধ্যে দুটি ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।

রাশিয়া এখন ছোট ও মডুলার রিঅ্যাক্টর (SMR) নির্মাণে ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রকল্পে আগ্রহী। ভারতের ২০৪৭ সালের মধ্যে ১০০ গিগাওয়াট পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।


প্রতিরক্ষা খাতে গভীর অংশীদারিত্ব

ভারতীয় সেনাবাহিনীর বহু প্রজন্ম রুশ তৈরি অস্ত্রের ওপর আস্থা রেখেছে। আলিপভ বলেন, “রুশ অস্ত্র ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি।”

ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—দুই দেশ যৌথভাবে সফল প্রকল্প চালিয়ে আসছে। এছাড়া উত্তর প্রদেশে একে-২০০ সিরিজ রাইফেল উৎপাদনও এখন স্থানীয় পর্যায়ে হচ্ছে।

রাশিয়া ভবিষ্যতে ভারতকে Su-57 পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরির প্রযুক্তিও সরবরাহ করতে প্রস্তুত, যা ভারতের নিজস্ব AMCA প্রকল্পকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

রাশিয়ার অবদান শুধু প্রতিরক্ষা নয়, বেসামরিক বিমান শিল্পেও সম্প্রসারিত হচ্ছে। সম্প্রতি হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড (HAL) ও রাশিয়ার ইউনাইটেড এয়ারক্রাফট করপোরেশন (UAC)–এর মধ্যে Sukhoi SJ-100 যাত্রীবিমান তৈরির বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে ভারত নিজ দেশে বিমান উৎপাদনের পাশাপাশি আঞ্চলিক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠবে।


ভারতীয় নাগরিকদের রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিষয়

রাষ্ট্রদূত স্বীকার করেন, কিছু ভারতীয় নাগরিক রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে—এটি দুই দেশের জন্যই উদ্বেগের বিষয়।

তিনি স্পষ্ট করে বলেন, রুশ সেনাবাহিনী কোনও ভারতীয় নাগরিককে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ করে না; যারা যোগ দিয়েছে, তারা নিজের ইচ্ছাতেই করেছে।

ভারত সরকার ইতিমধ্যে নাগরিকদের সতর্ক করেছে যেন তারা প্রতারণামূলক নিয়োগ সংস্থার ফাঁদে না পড়ে। এ বিষয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করছে।


ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক আজও অতীতের বিশ্বাস ও সহযোগিতার ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। পারমাণবিক শক্তি, প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও জ্বালানি নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রে এই অংশীদারিত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আরও গভীর ও বহুমাত্রিক হয়ে উঠছে।


#ভারত_রাশিয়া #কূটনীতি #পুতিন #রাশিয়া #ভারত #অর্থনীতি #প্রতিরক্ষা #জ্বালানি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট