বাজারে বুদবুদের আশঙ্কা
অক্টোবরে মাঝামাঝি সময়ে জেপি মরগান চেজের প্রধান নির্বাহী জেমি ডাইমন সতর্ক করে বলেন, “অনেক সম্পদই এখন বুদবুদের পর্যায়ে প্রবেশ করছে।” আমেরিকার সবচেয়ে বড় ব্যাংকের প্রধান হিসেবে তার এই সতর্কবার্তা বাজারে বড় প্রভাব ফেলে। একই ধরনের সতর্কতা শোনা যায় গোল্ডম্যান স্যাকসের ডেভিড সলোমন ও সিটিগ্রুপের জেন ফ্রেজারের কাছ থেকেও, যারা বিনিয়োগকারীদের “অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস” এবং “মূল্যায়নের অস্বাভাবিকতা” নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
ব্রিটিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সম্প্রতি বলেছে, “বাজারে তীব্র সংশোধনের ঝুঁকি বেড়েছে।” আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সতর্ক করেছে, “ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের দাম বাস্তবতার তুলনায় অনেক বেশি,” যা একটি “অগোছালো পতনের” আশঙ্কা তৈরি করছে।
উচ্চ মূল্যায়নের বাস্তবতা
সবাই একমত যে বাজারমূল্য এখন বিপজ্জনকভাবে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের শেয়ার কিনতে বিনিয়োগকারীদের এখন তাদের সমন্বিত আয়ের ৪০ গুণ দিতে হচ্ছে—যা ইতিহাসে কেবল ডটকম বুদবুদের সময় অতিক্রম করেছিল।
বিনিয়োগযোগ্য করপোরেট বন্ডগুলোও সমানভাবে ঝুঁকিপূর্ণ; বর্তমানে এগুলোর মুনাফা সরকারি বন্ডের তুলনায় মাত্র ০.৮ শতাংশ বেশি, যা ২০০৫ সালের পর সবচেয়ে কম, অর্থাৎ বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের আগমুহূর্তের সমতুল্য।
এমনকি স্বর্ণও, যা সাধারণত নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে পরিচিত, এখন অস্থির। ২০ অক্টোবর স্বর্ণের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছানোর পর মাত্র দুই দিনেই ৭ শতাংশ কমে যায় এবং এখন তা শীর্ষমূল্যের চেয়ে ৯ শতাংশ নিচে।
পতনের পূর্বাভাস কতটা সম্ভব?
তাহলে কি বাজার সংশোধন ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে? এবং যদি তা হয়ে থাকে, পরবর্তী ধাক্কা কবে আসবে?
বাজারকে হারানোর স্বপ্ন দেখা বিনিয়োগকারী ও হেজ-ফান্ডগুলোর জন্য এটি এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এলম ওয়েলথের জেমস হোয়াইট বলেন, “ম্যাক্রো ট্রেডিংয়ের স্বর্গ হলো এই বাঁকবদলের সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া।”
কিন্তু সেই ‘স্বর্গ’ অর্জন কার্যত অসম্ভব।
অস্থিরতা নির্ভর পূর্বাভাস
বাজার পতনের পূর্বাভাস দিতে হলে মূলত অস্থিরতা বা ‘ভলাটিলিটি’ অনুমান করতে হয়—অর্থাৎ সম্পদের দামের ওঠানামার প্রবণতা।
ব্যবসায়ীরা সাধারণত লক্ষ্য করেন, দাম দীর্ঘ সময় ধরে স্থির থাকে বা ধীরে বাড়ে, তারপর হঠাৎ অল্প সময়ে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এভাবেই বাজারে দুটি ধরণ দেখা যায়—‘কম অস্থির’ ও ‘বেশি অস্থির’ সময়কাল।
যখন অস্থিরতা কম, দাম সাধারণত স্থিতিশীল বা ঊর্ধ্বমুখী থাকে। আবার অস্থিরতা বাড়লে দাম পড়ে যায়।
এ কারণে ব্যবসায়ীরা ‘অটো-রিগ্রেসিভ’ মডেল ব্যবহার করেন, যা আজকের তথ্য থেকে আগামীকালের ঝুঁকি নির্ধারণ করে। এসব মডেল অপশন ট্রেডিংয়েও ব্যবহৃত হয়, কারণ দাম কতটা পরিবর্তিত হতে পারে তার অনুমান করাই এখানে মূল। তবে সমস্যা হলো, এসব মডেল বাজারে হঠাৎ পরিবর্তনের সময় কার্যকর নয়।
মেশিন লার্নিং ও নতুন পূর্বাভাস পদ্ধতি
এই সীমাবদ্ধতা কাটাতে অনেক ব্যবসায়ী এখন বাহ্যিক উপাদান বিশ্লেষণ করে মডেল তৈরি করেন। আধুনিকতম পদ্ধতিটি হলো মেশিন লার্নিং, যা করপোরেট আয়, জিডিপি, মুদ্রাস্ফীতি, চাকরির তথ্যসহ নানা অর্থনৈতিক সূচকের প্রভাব বিশ্লেষণ করে।
এই প্রযুক্তি এমন কিছু জটিল সম্পর্ক শনাক্ত করতে পারে, যা মানুষের বোঝা কঠিন। বিশ্বের বৃহত্তম হেজ-ফান্ডগুলোর একটি, ব্রিজওয়াটার, এমন কৌশলেই পরিচালিত হয়।

তবে বাস্তবে খুব কম প্রতিষ্ঠানই এসব মডেল দিয়ে বাজারকে হারাতে পারে। এক প্রাক্তন ট্রেডারের ভাষায়, “ব্রিজওয়াটার ছাড়া এমন মডেল দিয়ে টেকসই সাফল্য কেউ পায়নি।”
তাছাড়া এসব মডেলও মহামারি বা ব্যাংক দৌড়ের মতো “অপ্রত্যাশিত ধাক্কা” আগাম ধরতে পারে না, কারণ সেগুলো স্বভাবতই অনিশ্চিত।
সংকেত ধরার অন্যান্য উপায়
তবুও কিছু লক্ষণ রয়েছে যা ব্যবসায়ীরা পর্যবেক্ষণ করেন। যখন বাজারে বড় পতন শুরু হয়, তখন ‘মোমেন্টাম ট্রেডাররা’ সাধারণত দ্রুত তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেয়।
আবার বিভিন্ন সম্পদের পারস্পরিক সম্পর্কও অনেক সময় ইঙ্গিত দেয়—যেমন শেয়ারবাজার পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণ ও সরকারি বন্ডের দাম বাড়লে বোঝা যায় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ থেকে সরে যাচ্ছে।
পূর্বাভাস নয়, প্রস্তুতিই মূল
একাধিক মডেল একত্র করে বিশ্লেষণ করা কিছুটা উন্নত ফল দিতে পারে, বলেন এক শীর্ষ হেজ-ফান্ডের পরিমাণগত কৌশল বিভাগের প্রধান।
তবে তিনি স্বীকার করেন, কোনো ভবিষ্যদ্বাণীমূলক ক্ষমতা ছাড়া একজন ট্রেডারের পক্ষে সর্বোচ্চ যা সম্ভব, তা হলো পতনের প্রাথমিক ইঙ্গিত ধরতে পারা এবং দ্রুত ক্ষতি কমানো।
ওয়াল স্ট্রিটের বড় বড় প্রতিষ্ঠান হয়তো ধসের সতর্কতা দিতে পারে, কিন্তু কখন সেই ধস আসবে—তা বলার সাহস তাদেরও নেই।
#বাজারধস #ওয়ালস্ট্রিট #অর্থনীতি #বিনিয়োগ #আর্থিকসংকট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















