শিশু যত্নের খরচ ও সামাজিক চাপ
ধনী দেশগুলোর পরিবারগুলো, বিশেষ করে যাদের ছোট সন্তান আছে, তারা এক জটিল সমস্যার মুখে। যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে শিশু যত্নে সরকারি সহায়তা সীমিত, সেখানে দুই কর্মরত অভিভাবক ও দুই সন্তানের পরিবারকে প্রায় বাড়িভাড়ার সমান খরচ বহন করতে হয়।
এর ফলেই অনেকে সন্তান নেওয়া বিলম্বিত করছেন বা সন্তানসংখ্যা সীমিত রাখছেন। অনেক নারী আবার চাকরিতে ফিরতে পারেন না, কারণ তাদের বেতনের বড় অংশই শিশু যত্নে ব্যয় হয়।
রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও নীতিগত পরিবর্তন
এ সমস্যা সমাধানে রাজনীতিকদের মধ্যে নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান নেতারা যেমন করছাড় ও নগদ সহায়তার মাধ্যমে মায়েদের ঘরে থাকার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, তেমনি ডেমোক্র্যাট নেতারা সরকারি সহায়তা বাড়াচ্ছেন।
নিউ মেক্সিকোর গভর্নর মিশেল লুজান গ্রিশাম ঘোষণা করেছেন, ছয় সপ্তাহ বয়স থেকেই সব শিশুর জন্য বিনামূল্যে যত্নের সুযোগ থাকবে—আগে এটি কেবল নিম্ন ও মধ্য আয়ের পরিবারের জন্য ছিল। আগামী বছর নিউ ইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি একই পথ অনুসরণ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
এছাড়া ভারমন্ট ও ওয়াশিংটন রাজ্যেও ভর্তুকি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বিশ্বের অন্যান্য ধনী দেশেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া আগামী বছর থেকে শিশু যত্নে সরকারি ভর্তুকি বাড়াবে। ব্রিটেনে বছরে £১০০,০০০-এর কম আয় করা পরিবারগুলো সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টা বিনামূল্যে শিশু যত্ন পাবে। নিউজিল্যান্ডে মধ্য ও নিম্ন আয়ের অভিভাবকরা এখন ফি-এর ৪০% পর্যন্ত ফেরত পেতে পারেন।
“সর্বজনীন যত্ন” ধারণা ও বাস্তবতা
সবার জন্য শিশু যত্নের ধারণা আকর্ষণীয় শোনালেও, গবেষণা বলছে—জন্মের পর থেকেই বিনামূল্যে যত্ন শিশুর বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
১৯৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইপ্সিলান্টি শহরে পরিচালিত “পেরি প্রি-স্কুল” পরীক্ষায় দেখা যায়, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য সীমিত সময়ের উচ্চমানের শিক্ষা দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক ফল দেয়। তারা পড়াশোনায় উন্নতি করে, অপরাধ কমায় এবং সমাজে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
অর্থনীতিবিদ জেমস হেকম্যান-এর গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধরনের বিনিয়োগ বছরে ৭–১০% পর্যন্ত ফেরত দেয়। এ কারণেই বহু দেশ প্রাথমিক শিশুশিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহিত হয়েছে।
কানাডার কুইবেকে “সস্তা যত্ন” ও তার পরিণতি
১৯৯৭ সালে কুইবেক প্রদেশ সরকার মাত্র ৫ ডলার দৈনিক খরচে পূর্ণসময়ের শিশু যত্ন চালু করে। এতে কর্মজীবী মায়ের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়—মাতৃত্বকালীন কর্মসংস্থান পৌঁছায় ৮৭ শতাংশে।

তবে গবেষণায় দেখা গেছে, এই প্রকল্প শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ, অতিসক্রিয়তা ও আক্রমণাত্মক আচরণ বাড়িয়েছে, কমিয়েছে সামাজিক ও মোটর দক্ষতা। কৈশোরে এসে অনেক শিশু জীবন নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে এবং অপরাধ প্রবণতাও বেড়েছে।
মানের গুরুত্ব: হেকম্যানের সতর্কবার্তা
অর্থনীতিবিদ হেকম্যান এই প্রকল্পকে “গুদামঘর” বলে উল্লেখ করেছিলেন—যেখানে মানসম্মত শেখার পরিবেশ ছিল না। তার মতে, শিশু যত্নে “গুণমান” না থাকলে সেটি সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
দরিদ্র বনাম সর্বজনীন যত্ন
“পেরি” ও “কুইবেক” প্রকল্পের তুলনা স্পষ্ট করে দেখিয়েছে—দরিদ্র শিশুদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক, উচ্চমানের প্রোগ্রাম সফল হলেও, সবার জন্য নিম্নমানের যত্ন উল্টো ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে।
নর্থ ক্যারোলিনার “অ্যাবেসিডেরিয়ান প্রকল্প”ও প্রমাণ করেছে, দরিদ্র শিশুদের জন্য পূর্ণদিনের মানসম্পন্ন যত্ন ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে তিন বছরের নিচের সব শিশুর জন্য একই সুবিধা কার্যকর নয়।
নবজাতকদের যত্নে জটিলতা
শিশুদের প্রাথমিক বিকাশ নির্ভর করে প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি মিথস্ক্রিয়ার ওপর—অন্য শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানোর ওপর নয়।

ফ্রান্সের গবেষণায় দেখা গেছে, এক বছর বয়সে ক্রেশে ভর্তি শিশুদের আচরণ তুলনামূলকভাবে খারাপ হতে পারে, যদি তাদের মায়েরা বা প্রশিক্ষিত সহকারীরা যত্ন না নেন।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা: “সাশ্রয়ী” যত্নের প্রকৃত খরচ
উচ্চ মান বজায় রাখতে শিশু যত্নের ব্যয় বিশাল। একজন শিক্ষক যেখানে স্কুলে ২০ – ৩০ জন শিশুকে সামলাতে পারেন, সেখানে নবজাতকের ক্ষেত্রে একজন কর্মীকে দুই বা তিনজন শিশুর যত্ন নিতে হয়।
ফিনল্যান্ড এই ক্ষেত্রে সফল হলেও, সেখানে সরকারের ব্যয় গড় OECD দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
নিউ মেক্সিকো, তেলের রাজস্ব দিয়ে এই প্রকল্প চালাচ্ছে, কিন্তু নিউ ইয়র্কের মতো রাজ্যে অর্থায়ন কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন অভিভাবকদের জন্য এটি ব্যয়বহুল, ফিনল্যান্ড সরকারের ক্ষেত্রেও তেমনি। আর যারা কম খরচে করতে চায়, তাদের জন্য ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।
শিশু যত্নে খরচ অনিবার্য—তা হোক পিতামাতার পকেট থেকে, সরকারের কর থেকে, কিংবা ভবিষ্যতের শিশুবিকাশের ক্ষতির মাধ্যমে।
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়, যখন মায়েদের দীর্ঘদিন ঘরে থাকতে বাধ্য করা হয় অথবা পরিবারগুলোকে কম খরচে নিম্নমানের যত্ন ব্যবস্থায় শিশু পাঠাতে প্রলুব্ধ করা হয়।
দুঃখজনকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদরা বর্তমানে এই দুই চরম বিকল্পের মধ্যেই পথ খুঁজছেন।
#childcare #policy #education #economy #TheEconomist
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















