ব্রাজিলের কুয়েরেন্সিয়া অঞ্চলের এক হেক্টর অ্যামাজন বনভূমির উপরে শত শত স্বচ্ছ প্লাস্টিক প্যানেল ঝুলিয়ে গবেষকরা সেই অঞ্চলের মাটিতে পৌঁছানো পানির অর্ধেক আটকাচ্ছেন। এই পরীক্ষার লক্ষ্য হলো—বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়তে থাকা চরম খরার প্রভাবের বিরুদ্ধে অ্যামাজন বনের সহনশীলতার সীমা জানা।
এই প্রকল্পটির নাম ‘সেকা লিমিতে’ ( Limit Drought ), যার আওতায় কাঠের উঁচু নালার মাধ্যমে বৃষ্টির পানি অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের রোগীর মতোই, ৬১টি গাছের শারীরিক তথ্য প্রতিদিন মাপা হচ্ছে—রস প্রবাহ, কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন, শ্বাস-প্রশ্বাস, তাপমাত্রা ইত্যাদি—সবই সৌরশক্তি-চালিত যন্ত্রের মাধ্যমে।
ব্রিটেনের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থলজ প্রতিবেশব্যবস্থা-বিষয়ক অধ্যাপক ডেভিড গ্যালব্রেইথ বলেন, “এটি এমন, যেন কেউ প্রতিদিন তোমার নাড়ি ও নিঃশ্বাসের হিসাব নিচ্ছে।”

প্রযুক্তি ও গবেষণা: বনের নাড়ির খোঁজে
গবেষকেরা গাছের কাণ্ডের আকার, মাটির আর্দ্রতা এবং পাতা পড়ার হারও পর্যবেক্ষণ করছেন। ছয় মিটার গভীর গর্ত থেকে মাটির তথ্য নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত ড্রোন দিয়ে বনের থ্রিডি মডেল তৈরি করা হয়েছে।
অ্যামাজনের বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড় এবং মানবসৃষ্ট অবক্ষয়ের ফলে শুকনো মৌসুম ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে অ্যামাজনের কিছু অংশ হয়তো এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে, যেখান থেকে প্রকৃতি আর ফিরে আসতে পারবে না।
অ্যামাজনের নতুন বাস্তবতা: তাপ ও মানবচাপ
এই পরীক্ষাস্থলটি অ্যামাজনের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, যেখানে বনভূমি ধীরে ধীরে সাভানায় পরিণত হচ্ছে। এখানে তাপমাত্রা বেশি এবং কৃষিকাজও অনেক ব্যাপক। ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব পারার ভূবিজ্ঞান অধ্যাপক আন্তোনিও কার্লোস লোলা দা কস্তা বলেন, “এলাকাটি যেন জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে আছে—একদিকে কৃষির অগ্রগতি, অন্যদিকে বনের টিকে থাকার লড়াই।”
বন সংরক্ষণের বিশ্বমঞ্চে বিতর্ক
ব্রাজিলের বেলেম শহরে শুরু হওয়া জাতিসংঘের COP30 জলবায়ু সম্মেলনে অ্যামাজন বনের সুরক্ষা অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। বিজ্ঞানীদের মতে, বন উজাড়, অগ্নিসংযোগ ও জীববৈচিত্র্য হ্রাসের ফলে অ্যামাজনের বিশাল অংশ হয়তো সাভানা বা অল্পবৃক্ষবিশিষ্ট তৃণভূমিতে রূপ নিতে পারে।
‘নেচার’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে অ্যামাজনের ১০ থেকে ৪৭ শতাংশ অংশ অন্য প্রতিবেশ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এতে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

চার খরার ধাক্কা ও অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা
২১শ শতকে অ্যামাজন ইতোমধ্যেই চারটি মারাত্মক খরার মুখোমুখি হয়েছে, যা ২০২৪ সালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডকে আরও তীব্র করেছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব ইতিহাসের সর্বোচ্চে পৌঁছায়—যার কারণ হিসেবে বন আগুন ও খরাগ্রস্ত বনের কার্বন শোষণক্ষমতা হ্রাসকে দায়ী করা হয়েছে।
ইতিহাসের ছাপ: বন উজাড়ের সূচনা
গত তিন হাজার বছর ধরে অ্যামাজন বন দক্ষিণ দিকে প্রসারিত হচ্ছিল। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকে ব্রাজিলের সামরিক সরকার রাস্তা নির্মাণ ও উপনিবেশ স্থাপনের কর্মসূচি শুরু করলে দ্রুত বন উজাড় শুরু হয়।
গবেষক বেন হুর মারিমন জুনিয়র বলেন, “তখন ব্রাজিলে যে কেউ জমি পেতে পারত, যদি সে বন পুড়িয়ে সেটি দখল করত।” তিনি ও তাঁর স্ত্রী, পরিবেশবিদ বিয়াত্রিজ মারিমন, গত তিন দশক ধরে এই অঞ্চলে বন পরিবর্তনের তথ্য সংগ্রহ করছেন।
তাঁদের তথ্য অনুযায়ী, অ্যামাজনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে গাছের মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। “১৯৯৪ সালে আমরা পরিমাপ শুরু করি; ১৫ বছর পর বুঝতে পারি, গাছগুলো অস্বাভাবিক হারে মারা যাচ্ছে,” বলেন বিয়াত্রিজ।
মরতে থাকা গাছ ও বনভূমির ভবিষ্যৎ
নোভা শাভান্তিনা এলাকায় তাঁরা যে বনাঞ্চল পর্যবেক্ষণ করছেন, সেখানে ৩০ মিটারের বেশি উঁচু এক প্রাচীন গাছের কাণ্ড পচতে শুরু করেছে। বেন হুর বলেন, “ওটা তিনশ বছরের পুরনো, কিন্তু আর একশ বছরও টিকবে না।”
এক বছরের চরম খরা গাছকে দুর্বল করে দেয়, ফলে পরের খরায় তা সহজেই মারা যায়। বিয়াত্রিজ জানান, “খরা আর আগুনের পারস্পরিক প্রভাবই সবচেয়ে ভয়ানক।”
২০২৪ সালে অ্যামাজনের পুড়ে যাওয়া এলাকার পরিমাণ ছিল আগের ৪০ বছরের তুলনায় দ্বিগুণ, যা ম্যাপবায়োমাস গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ রেকর্ড।

আশার ঝলক: অভিযোজনের সম্ভাবনা
তবে কিছু গবেষণা আশাব্যঞ্জক। অ্যামাজনের উত্তরাংশে করা এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রথম ১৫ বছরে এক-তৃতীয়াংশ জীবদ্রব্য হারালেও, পরবর্তীতে বন নতুন বাস্তবতায় খাপ খাইয়ে নেয়—যদিও গাছ ছোট হয় এবং ছায়া কমে যায়, তবু বন টিকে থাকে।
তবে ‘লিমিট ড্রাউট ’ পরীক্ষার ফল ভিন্ন হতে পারে, কারণ এটি অ্যামাজনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে, যেখানে বন খণ্ডিত হয়ে গেছে সয়াবিন ক্ষেত ও গবাদি পশুর চারণভূমিতে।
বিয়াত্রিজের মতে, “মানুষ জলবায়ু বিপর্যয়ের কথা যত বলে, তার চেয়ে বড় বিপদ এই মানবসৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ। ট্রাক্টরের ব্লেডই আসল টিপিং পয়েন্ট—যেখানে একবার কাটা পড়লে, সেই বন আর কখনও ফিরে আসবে না।”
#অ্যামাজন #জলবায়ুপরিবর্তন #বনউজাড় #পরিবেশ #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















