০৬:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫
কৃষিজমি রক্ষায় জরুরি আইন প্রণয়নের আহ্বান ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনী: পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব কাঠামোয় কীভাবে বড় পরিবর্তন আনবে ভারতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে রাশিয়ার নতুন পরিকল্পনা, ডিসেম্বরে আসছেন পুতিন মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড সীমান্তে নৌকাডুবিতে রোহিঙ্গারা নিখোঁজ,মানবতার আরেক ট্র্যাজেডি আদানিকে ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের সিদ্ধান্ত ইসলামাবাদ আদালতের বাইরে আত্মঘাতী হামলায় নিহত ১২, আহত ২৭ গ্লোবাল ফাইন্যান্সের মূল্যায়নে ‘সি’ গ্রেড পেলেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর পাকিস্তান ২৭তম সংশোধনী বিল অনুমোদিত, বাড়বে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাও বিচার বিভাগে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ মোহাম্মদপুরে ছাত্রদল নেতার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার বাংলাদেশে আসছেন পাকিস্তানের জামিয়াতে উলেমা-ই-ইসলাম প্রধান মৌলানা ফজলুর রহমান

আফগান-পাকিস্তান আলোচনায় অচলাবস্থা: সীমান্তে আবারও সংঘাতের আশঙ্কা

ইস্তানবুলে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা পুনরায় বাড়ছে। বিশ্লেষকদের মতে, সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে পুরো অঞ্চল আবারও অস্থিতিশীলতার মুখে পড়তে পারে।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, “ইস্তানবুলের আলোচনা স্থবির অবস্থায় পৌঁছেছে এবং শেষ হয়েছে।” এটি ছিল গত অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া তৃতীয় দফার আলোচনা।

কূটনীতিক ও বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্ত সংঘাত উভয় দেশের পাশাপাশি পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তাকে অস্থিতিশীল করতে পারে।

তুরস্ক ও কাতারের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত এই আলোচনার পেছনে ছিল পাকিস্তানের ভেতরে বেড়ে চলা সীমান্তপারের হামলা, যা চালাচ্ছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। ইসলামাবাদ অভিযোগ করেছে, কাবুলের তালেবান সরকার এ সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আশ্রয় দিচ্ছে।

গত কয়েক মাসে টিটিপির এসব হামলায় পাকিস্তানের বহু নিরাপত্তা সদস্য নিহত হয়েছে। এর জবাবে পাকিস্তান কাবুলসহ আফগানিস্তানের কয়েকটি প্রদেশে বিমান হামলা চালায়, যা দুই প্রতিবেশী দেশকে খোলামেলা সংঘাতের প্রান্তে নিয়ে গেছে।

পাকিস্তানের সতর্কবার্তা

এক পূর্ববর্তী ব্যর্থ আলোচনার পর খাজা আসিফ এক্স (পূর্বে টুইটার)-এ সতর্ক করে বলেন, “তালেবানকে নিশ্চিত করতে চাই—পাকিস্তান তার সামরিক শক্তির সামান্য অংশ ব্যবহার করেই তাদের শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে সক্ষম।”

৭ নভেম্বর তিনি আবারও বলেন, আফগান ভূখণ্ড থেকে কোনো হামলা হলে পারমাণবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তান “যথাযথ প্রতিক্রিয়া” জানাবে।

সংখ্যার দিক থেকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে আনুমানিক ৬ লাখ ৫০ হাজার সদস্য রয়েছে, যাদের সংগঠন ও প্রশিক্ষণ তালেবান বাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি পেশাদার। অন্যদিকে আফগান তালেবান যোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ পাঁচ হাজার, যারা মূলত স্থলভিত্তিক গেরিলা বাহিনী হিসেবে কাজ করে।

পাকিস্তানের হাতে আধুনিক যুদ্ধবিমান ও ট্যাংক রয়েছে, কিন্তু তালেবান এখনও পুরোনো মার্কিন ও সোভিয়েত যুগের অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল। তবে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, সংঘাত বাড়লে তালেবান দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারে।

করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনিস আহমার বলেন, “সামরিক সক্ষমতায় দুই দেশের তুলনা নেই, কিন্তু তালেবানের গেরিলা কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো, তারা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক জনগণের ওপর দীর্ঘ ও সমন্বিত হামলা চালিয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।”

সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস

ইসলামাবাদ ২০২১ সাল থেকে অভিযোগ করে আসছে যে, তালেবান সরকার টিটিপিকে আশ্রয় দিচ্ছে—সেই বছরই যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে।

টিটিপি ২০০১ সাল থেকে পাকিস্তানের সেনা ও বেসামরিক লক্ষ্যে হামলা চালিয়ে আসছে। তাদের লক্ষ্য পাকিস্তান সরকারকে উৎখাত করে পশতু অধ্যুষিত সীমান্ত অঞ্চলে শরিয়াভিত্তিক আমিরাত গঠন।

সবচেয়ে কুখ্যাত হামলার মধ্যে রয়েছে ২০১২ সালে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের ওপর হামলা এবং ২০১৪ সালের পেশোয়ার স্কুল হত্যাযজ্ঞ, যেখানে ১৩২ জনের বেশি শিশু নিহত হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দাবি, আফগানিস্তানে তালেবান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে টিটিপি সেখানে আশ্রয় নিয়ে পাকিস্তানে হামলার তৎপরতা বাড়িয়েছে।

তালেবানের দাবি ও সীমান্ত বিরোধ

আলোচনার সময় তালেবান দাবি তোলে পাকিস্তানের প্রাক্তন উপজাতীয় এলাকা (ফাটা) পুনরুদ্ধারের।

এক সূত্র জানায়, “পাকিস্তানের টিটিপি-আশ্রয় বন্ধের যৌক্তিক দাবি উপেক্ষা করে তালেবান ফাটা পুনর্বহাল ও আফগানিস্তানধর্মী শরিয়া আইন চালুর দাবি তোলে।”

ঐতিহাসিকভাবে ফাটা ছিল খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আধা-স্বশাসিত এলাকা, যা আফগানিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ ও সহজে পারাপারযোগ্য সীমান্ত ভাগ করে। ২০১৮ সালে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের এক আইনে ফাটাকে খাইবার পাখতুনখোয়ায় একীভূত করে, এর স্বতন্ত্র প্রশাসনিক মর্যাদা বিলুপ্ত হয়।

এই দাবি ইসলামাবাদের জন্য সংবেদনশীল, কারণ এটি আফগানিস্তানের পুরোনো সীমান্ত দাবিকে আবার উসকে দেয়। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে আঁকা দুরান্দ রেখা আফগানিস্তান কখনও স্বীকৃতি দেয়নি, এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এটি বিরোধের কারণ হয়ে আছে।

ওয়াশিংটনের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ট্রিসিয়া বেকন বলেন, “এই দাবি পাকিস্তান অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করবে, কারণ এর পেছনে টিটিপির উদ্দেশ্য হলো এমন একটি অঞ্চল তৈরি করা যা তারা পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।”

ভারতীয় প্রভাবের অভিযোগ

পাকিস্তান আরও অভিযোগ করছে যে, তাদের পূর্ব প্রতিবেশী ভারত আফগানিস্তানে টিটিপিকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী টিটিপিকে “ফিতনা আল-খাওয়ারিজ” বা “বিদ্রোহীদের অভিশাপ” বলে আখ্যা দেয় এবং একে ভারতীয় মদদপুষ্ট প্রক্সি গোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করে।

এই অভিযোগ আরও জোরালো হয় যখন গত অক্টোবরের মাঝামাঝি আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারতের সফর করেন—সেই সময় পাকিস্তান সীমান্তে তীব্র সংঘর্ষ চলছিল।

অধ্যাপক বেকন বলেন, “তালেবানের সঙ্গে ভারতের উষ্ণ সম্পর্ক আসলে ইসলামাবাদের প্রতি তাদের শত্রুতামূলক মনোভাবের প্রতিফলন। তবে নয়াদিল্লি হয়তো এই মনোভাবকে উৎসাহ দিচ্ছে।”

ড. আহমার মন্তব্য করেন, “গত পাঁচ দশক ধরে পাকিস্তান আফগানিস্তানকে আশ্রয় ও রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে। এখন কাবুল ভারতের প্রক্সি হিসেবে কাজ করে ইসলামাবাদের স্বার্থবিরোধী অবস্থান নিচ্ছে—এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।”

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান তিনটি যুদ্ধ করেছে। ২০১৯ সালের মে মাসে তারা আবার পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল, যখন বিমান হামলা ও সংঘর্ষ শুরু হয়।

যুক্তরাষ্ট্রও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে টিটিপির কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ২০২৫ সালের মূল্যায়নে বলা হয়, যদিও টিটিপির প্রধান লক্ষ্য পাকিস্তান, তবু আল-কায়েদার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক হামলার সম্ভাবনা বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

অধ্যাপক বেকনের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালের পর পুনরায় সৈন্য পাঠাবে না, তবে পাকিস্তানের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা বাড়তে পারে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও সেনাপ্রধান আসিম মুনির সম্প্রতি একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট  ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ট্রাম্প  পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং শান্তিচুক্তি অর্জনে সহায়তার প্রস্তাব দেন।

ইসলামাবাদ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও গোয়েন্দা সহযোগিতা ও সরঞ্জাম, বিশেষ করে নাইট ভিশন গগলস, চেয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সহায়তার জন্য।

নতুন সংঘাতের আশঙ্কা

আলোচনায় অচলাবস্থা ও উভয় পক্ষের অনমনীয় অবস্থানের কারণে পাকিস্তান-আফগান সীমান্ত এখন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

যদি ইসলামাবাদ ও কাবুল নিজেদের প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণে না রাখে এবং সীমান্ত সহিংসতা না ঠেকায়, তবে অঞ্চলটি আবারও ২০০০ সালের মতো অস্থিরতার দিকে গড়াতে পারে—যার প্রভাব শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তার ওপরও পড়বে।

ড. আহমার সতর্ক করে বলেন, “যদি শান্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়, ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করবে—এবং এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

জনপ্রিয় সংবাদ

কৃষিজমি রক্ষায় জরুরি আইন প্রণয়নের আহ্বান

আফগান-পাকিস্তান আলোচনায় অচলাবস্থা: সীমান্তে আবারও সংঘাতের আশঙ্কা

০৩:৫৫:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর ২০২৫

ইস্তানবুলে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা পুনরায় বাড়ছে। বিশ্লেষকদের মতে, সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে পুরো অঞ্চল আবারও অস্থিতিশীলতার মুখে পড়তে পারে।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, “ইস্তানবুলের আলোচনা স্থবির অবস্থায় পৌঁছেছে এবং শেষ হয়েছে।” এটি ছিল গত অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া তৃতীয় দফার আলোচনা।

কূটনীতিক ও বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্ত সংঘাত উভয় দেশের পাশাপাশি পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তাকে অস্থিতিশীল করতে পারে।

তুরস্ক ও কাতারের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত এই আলোচনার পেছনে ছিল পাকিস্তানের ভেতরে বেড়ে চলা সীমান্তপারের হামলা, যা চালাচ্ছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। ইসলামাবাদ অভিযোগ করেছে, কাবুলের তালেবান সরকার এ সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আশ্রয় দিচ্ছে।

গত কয়েক মাসে টিটিপির এসব হামলায় পাকিস্তানের বহু নিরাপত্তা সদস্য নিহত হয়েছে। এর জবাবে পাকিস্তান কাবুলসহ আফগানিস্তানের কয়েকটি প্রদেশে বিমান হামলা চালায়, যা দুই প্রতিবেশী দেশকে খোলামেলা সংঘাতের প্রান্তে নিয়ে গেছে।

পাকিস্তানের সতর্কবার্তা

এক পূর্ববর্তী ব্যর্থ আলোচনার পর খাজা আসিফ এক্স (পূর্বে টুইটার)-এ সতর্ক করে বলেন, “তালেবানকে নিশ্চিত করতে চাই—পাকিস্তান তার সামরিক শক্তির সামান্য অংশ ব্যবহার করেই তাদের শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে সক্ষম।”

৭ নভেম্বর তিনি আবারও বলেন, আফগান ভূখণ্ড থেকে কোনো হামলা হলে পারমাণবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তান “যথাযথ প্রতিক্রিয়া” জানাবে।

সংখ্যার দিক থেকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে আনুমানিক ৬ লাখ ৫০ হাজার সদস্য রয়েছে, যাদের সংগঠন ও প্রশিক্ষণ তালেবান বাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি পেশাদার। অন্যদিকে আফগান তালেবান যোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ পাঁচ হাজার, যারা মূলত স্থলভিত্তিক গেরিলা বাহিনী হিসেবে কাজ করে।

পাকিস্তানের হাতে আধুনিক যুদ্ধবিমান ও ট্যাংক রয়েছে, কিন্তু তালেবান এখনও পুরোনো মার্কিন ও সোভিয়েত যুগের অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল। তবে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, সংঘাত বাড়লে তালেবান দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারে।

করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনিস আহমার বলেন, “সামরিক সক্ষমতায় দুই দেশের তুলনা নেই, কিন্তু তালেবানের গেরিলা কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো, তারা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক জনগণের ওপর দীর্ঘ ও সমন্বিত হামলা চালিয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।”

সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস

ইসলামাবাদ ২০২১ সাল থেকে অভিযোগ করে আসছে যে, তালেবান সরকার টিটিপিকে আশ্রয় দিচ্ছে—সেই বছরই যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে।

টিটিপি ২০০১ সাল থেকে পাকিস্তানের সেনা ও বেসামরিক লক্ষ্যে হামলা চালিয়ে আসছে। তাদের লক্ষ্য পাকিস্তান সরকারকে উৎখাত করে পশতু অধ্যুষিত সীমান্ত অঞ্চলে শরিয়াভিত্তিক আমিরাত গঠন।

সবচেয়ে কুখ্যাত হামলার মধ্যে রয়েছে ২০১২ সালে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের ওপর হামলা এবং ২০১৪ সালের পেশোয়ার স্কুল হত্যাযজ্ঞ, যেখানে ১৩২ জনের বেশি শিশু নিহত হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দাবি, আফগানিস্তানে তালেবান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে টিটিপি সেখানে আশ্রয় নিয়ে পাকিস্তানে হামলার তৎপরতা বাড়িয়েছে।

তালেবানের দাবি ও সীমান্ত বিরোধ

আলোচনার সময় তালেবান দাবি তোলে পাকিস্তানের প্রাক্তন উপজাতীয় এলাকা (ফাটা) পুনরুদ্ধারের।

এক সূত্র জানায়, “পাকিস্তানের টিটিপি-আশ্রয় বন্ধের যৌক্তিক দাবি উপেক্ষা করে তালেবান ফাটা পুনর্বহাল ও আফগানিস্তানধর্মী শরিয়া আইন চালুর দাবি তোলে।”

ঐতিহাসিকভাবে ফাটা ছিল খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আধা-স্বশাসিত এলাকা, যা আফগানিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ ও সহজে পারাপারযোগ্য সীমান্ত ভাগ করে। ২০১৮ সালে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের এক আইনে ফাটাকে খাইবার পাখতুনখোয়ায় একীভূত করে, এর স্বতন্ত্র প্রশাসনিক মর্যাদা বিলুপ্ত হয়।

এই দাবি ইসলামাবাদের জন্য সংবেদনশীল, কারণ এটি আফগানিস্তানের পুরোনো সীমান্ত দাবিকে আবার উসকে দেয়। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে আঁকা দুরান্দ রেখা আফগানিস্তান কখনও স্বীকৃতি দেয়নি, এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এটি বিরোধের কারণ হয়ে আছে।

ওয়াশিংটনের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ট্রিসিয়া বেকন বলেন, “এই দাবি পাকিস্তান অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করবে, কারণ এর পেছনে টিটিপির উদ্দেশ্য হলো এমন একটি অঞ্চল তৈরি করা যা তারা পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।”

ভারতীয় প্রভাবের অভিযোগ

পাকিস্তান আরও অভিযোগ করছে যে, তাদের পূর্ব প্রতিবেশী ভারত আফগানিস্তানে টিটিপিকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী টিটিপিকে “ফিতনা আল-খাওয়ারিজ” বা “বিদ্রোহীদের অভিশাপ” বলে আখ্যা দেয় এবং একে ভারতীয় মদদপুষ্ট প্রক্সি গোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করে।

এই অভিযোগ আরও জোরালো হয় যখন গত অক্টোবরের মাঝামাঝি আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারতের সফর করেন—সেই সময় পাকিস্তান সীমান্তে তীব্র সংঘর্ষ চলছিল।

অধ্যাপক বেকন বলেন, “তালেবানের সঙ্গে ভারতের উষ্ণ সম্পর্ক আসলে ইসলামাবাদের প্রতি তাদের শত্রুতামূলক মনোভাবের প্রতিফলন। তবে নয়াদিল্লি হয়তো এই মনোভাবকে উৎসাহ দিচ্ছে।”

ড. আহমার মন্তব্য করেন, “গত পাঁচ দশক ধরে পাকিস্তান আফগানিস্তানকে আশ্রয় ও রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে। এখন কাবুল ভারতের প্রক্সি হিসেবে কাজ করে ইসলামাবাদের স্বার্থবিরোধী অবস্থান নিচ্ছে—এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।”

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান তিনটি যুদ্ধ করেছে। ২০১৯ সালের মে মাসে তারা আবার পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল, যখন বিমান হামলা ও সংঘর্ষ শুরু হয়।

যুক্তরাষ্ট্রও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে টিটিপির কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ২০২৫ সালের মূল্যায়নে বলা হয়, যদিও টিটিপির প্রধান লক্ষ্য পাকিস্তান, তবু আল-কায়েদার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক হামলার সম্ভাবনা বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

অধ্যাপক বেকনের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালের পর পুনরায় সৈন্য পাঠাবে না, তবে পাকিস্তানের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা বাড়তে পারে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও সেনাপ্রধান আসিম মুনির সম্প্রতি একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট  ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ট্রাম্প  পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং শান্তিচুক্তি অর্জনে সহায়তার প্রস্তাব দেন।

ইসলামাবাদ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও গোয়েন্দা সহযোগিতা ও সরঞ্জাম, বিশেষ করে নাইট ভিশন গগলস, চেয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সহায়তার জন্য।

নতুন সংঘাতের আশঙ্কা

আলোচনায় অচলাবস্থা ও উভয় পক্ষের অনমনীয় অবস্থানের কারণে পাকিস্তান-আফগান সীমান্ত এখন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

যদি ইসলামাবাদ ও কাবুল নিজেদের প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণে না রাখে এবং সীমান্ত সহিংসতা না ঠেকায়, তবে অঞ্চলটি আবারও ২০০০ সালের মতো অস্থিরতার দিকে গড়াতে পারে—যার প্রভাব শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তার ওপরও পড়বে।

ড. আহমার সতর্ক করে বলেন, “যদি শান্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়, ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করবে—এবং এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।