বহু বছরের দখল, রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও জঙ্গি তৎপরতার পর তুলনামূলক স্থিতিশীল এক পর্যায়ে পৌঁছেছে ইরাক। এই শান্তি বজায় রাখাই ছিল সদ্য অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ইরাকিদের প্রধান অগ্রাধিকার। তবে ভোটের আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও বড় প্রশ্ন—ইরাকের রাজনীতিতে ইরানের প্রভাব কতটা ঠেকানো সম্ভব এবং যুক্তরাষ্ট্র কতটা ভূমিকা রাখতে চাইছে।
ইরাকের নির্বাচন: শান্তি রক্ষার প্রত্যাশা
ব্যাগদাদের রাস্তাজুড়ে ঝুলছে প্রার্থীদের পোস্টার—কোথাও উন্নয়ন, কোথাও শক্তি ও সমৃদ্ধির অঙ্গীকার। মোট ৭,৭০০ প্রার্থী ১১৪টি দলীয় তালিকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩২৯টি আসনের জন্য। ফল ঘোষণার পর জোটকরণে লাগবে সপ্তাহ, এমনকি মাসও।
প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-সুদানি দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–কে বলেন, “ইরাকিরা আর যুদ্ধ–সংঘাত সহ্য করতে পারছে না; তারা স্থিতি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন চায়।”
সুদানির জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
দেশে স্থিতিশীলতা ও নির্মাণ খাতের উত্থানের জন্য সুদানি প্রশংসা পেলেও তার কিছু সাবেক মিত্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে তিনি যেন দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করতে না পারেন। ইরানের প্রভাব কমানো এই নির্বাচনের অন্তর্নিহিত বড় প্রশ্ন হিসেবে রয়ে গেছে।
ইরান–সমর্থিত মিলিশিয়া: ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা

২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের পর ইরাকের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ সুন্নিদের হাত থেকে শিয়াদের হাতে আসে। ২০১৪ সালে আইএস–বিরোধী যুদ্ধে “পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস”-এর অংশ হিসেবে ইরান–সমর্থিত অসংখ্য শিয়া মিলিশিয়ার উত্থান ঘটে। আইএসের শক্তি কমে গেলেও এসব গোষ্ঠী আরও প্রভাবশালী হয়েছে। তারা দাবি করছে—মার্কিন সেনা যতদিন থাকবে, তাদের অস্ত্রও থাকবে।
বর্তমানে প্রায় ১,৩০০ মার্কিন সেনা ইরাকে আছে। সুদানি তাদের ধাপে ধাপে সরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি নিলেও যুক্তরাষ্ট্র বলছে—আইএস অবশিষ্টাংশ দমনে তাদের থাকা প্রয়োজন।
ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব দুর্বল, তবে ইরাকে শক্ত অবস্থান
হামাসের ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল আক্রমণের পর পশ্চিম এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য বদলে যায়। ইসরায়েল–ইরান সংঘাতে ইরানের বহু আঞ্চলিক মিত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। তবুও ইরাকে তাদের মিলিশিয়াগুলো রয়ে গেছে শক্তিশালী—সরকারি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করছে। ইরাক ও ইরানের কর্মকর্তারা বলছেন—এখন এদের বেশিরভাগই এত ধনী যে তেহরানের অর্থও প্রয়োজন হয় না।
নির্বাচনে ইরানপন্থি শক্তি
প্রায় সব ইরান–সমর্থিত মিলিশিয়াই নিজেদের নামে নির্বাচনী তালিকা দিয়েছে। সবচেয়ে ক্ষমতাধর মিলিশিয়া কাতাইব হিজবুল্লাহ দক্ষিণাঞ্চলে সমর্থকদের গাড়িবহর নিয়ে প্রচার শেষ করেছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছে—ইরান–সমর্থিত এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সহ্য করা হবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও “জরুরি ভিত্তিতে নিরস্ত্রীকরণের” কথা বলেছেন। মার্ক সাভায়া, নতুন মার্কিন দূত, ভোটের আগে জানান—ইরান–সমর্থিত দলের প্রভাবমুক্ত একটি সরকার চান তারা।
![]()
ইরান–যুক্তরাষ্ট্র টানাপোড়েনের মাঝে ইরাক
ইরান মার্কিন হস্তক্ষেপের নিন্দা করেছে; ইরাক পাল্টা বলেছে—তেহরান যেন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে। বাগদাদের রাস্তায় অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হলেও মিলিশিয়াদের শক্তি কমানোর বিষয়ে তারা ওয়াশিংটনের সঙ্গে মত মিলিয়েছে। তবে এসব গোষ্ঠীকে রাজনীতি থেকে আলাদা করা অত্যন্ত কঠিন।
মিলিশিয়াদের আর্থিক শক্তি ও প্রভাব
রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পে অংশ নিয়ে এসব গোষ্ঠী বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। ইরাক বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদনকারীদের একটি—এই আয় মিলিশিয়াদের আরও শক্তিশালী করছে।
ইরানের জন্য ইরাক অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১,৬০০ কিলোমিটার সীমান্ত ও দীর্ঘ যুদ্ধের ইতিহাস ইরানকে ইরাকে প্রভাব বজায় রাখতে বাধ্য করেছে।
সুদানির অবস্থান

তিনি দাবি করেন, মিলিশিয়াদের রাজনীতি বা অর্থনীতিতে আনা গেলে ধীরে ধীরে তারা অস্ত্র ত্যাগ করবে। কিন্তু মিলিশিয়া নেতারা বলেছেন—অস্ত্র ছাড়া হবে না।
কাতাইব হিজবুল্লাহর মুখপাত্র প্রকাশ্যে বলেন, “ইরাক শিয়া অভিভাবকত্বে রয়েছে—আমাদের অস্ত্র থাকবে আমাদের হাতেই।”
আমেরিকা–ইরান ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা
সুদানি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মাঝে ভারসাম্য রক্ষাকারী হিসেবে তুলে ধরছেন। তিনি শেভরন ও এক্সনকে ইরাকে তেলক্ষেত্র উন্নয়নের চুক্তি দিয়েছেন। এমনকি নিউইয়র্ক পোস্ট–এ নিবন্ধ লিখে ইরাককে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ অংশীদার হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি জানান—আগামী মাসে ৫০ জন ইরাকি বিলিয়নিয়ারকে নিয়ে আমেরিকায় “ইনভেস্ট ইন আমেরিকা” সম্মেলন করবেন।
ভোটে উদাসীনতা
রাজনৈতিক চালবাজিতে জনগণের আস্থা কমে গেছে। ২০ বছর বয়সী এক বিক্রেতা বলেন, “কেন ভোট দেব? একই শক্তিগুলোকেই নতুন নামে দেখা যায়।”
সরকার বলছে—ভোট টার্নআউট হয়েছে ৫৪ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে—নিবন্ধিত নয়, আসল ভোটার হিসেব করলে টার্নআউট প্রায় ৩৮ শতাংশ। বিশ্লেষক ইহসান আল-শাম্মারি বলেন, “এটি জনগণের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে দেখানোর কৌশল।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















