চীন তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরুজ্জীবিত করতে এমন সব খাত বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করছে, যেগুলো এতদিন কেবল রাষ্ট্রীয় তহবিলনির্ভর ছিল। রেলপথ, পারমাণবিক চুল্লি, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, তেল-গ্যাস পাইপলাইনসহ বৃহৎ অবকাঠামো এখন বিশেষ ১৩ দফা পরিকল্পনার মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে।
১৩ দফা উন্মুক্তকরণ পরিকল্পনা: কোন খাতগুলো খুলছে
চীনা রাষ্ট্রপরিষদের ঘোষণা অনুযায়ী, বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা এখন বিভিন্ন প্রকল্পে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার নিতে সক্ষম হবেন।
কেন্দ্রীয় অনুমোদন প্রয়োজন হলে প্রকল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ আনার সম্ভাব্যতা রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
রেলওয়ে, জলবিদ্যুৎ, বিদ্যুৎ পরিবহন, তেল-গ্যাস পাইপলাইন, পানি সরবরাহসহ বহু খাতে এই উন্মুক্ততা কার্যকর হবে।
অর্থনীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগের গুরুত্ব
চীনের জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের (NDRC) কর্মকর্তা গুয়ান পেং বলেন—
“বেসরকারি বিনিয়োগ অর্থনীতির প্রাণশক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এটি প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রত্যাশা স্থিতিশীল রাখতে বড় ভূমিকা রাখে।”
বাস্তবে এ বছরের প্রথম ৯ মাসে বেসরকারি খাত অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও ভবন খাতে বিনিয়োগ কমিয়েছে ৩.১ শতাংশ, যা প্রায় নজিরবিহীন।
৫০০ বিলিয়ন ইউয়ানের বিশেষ তহবিল
বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দিতে কেন্দ্র ৫০০ বিলিয়ন ইউয়ানের একটি বিশেষ তহবিল গঠন করেছে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারি উদ্যোগে ঋণসহায়তা দিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
তহবিলের একটি অংশ ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নতুন অগ্রাধিকার
বড় প্রকল্পে বেসরকারি অংশগ্রহণ বাড়ানো আগামী ১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অগ্রাধিকারগুলোর অন্যতম।
এ বছর কার্যকর হওয়া বেসরকারি খাত উন্নয়ন আইন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমান প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করছে।
নিম্ন-আকাশ অর্থনীতি ও স্যাটেলাইট যোগাযোগে নতুন সুযোগ
নিম্ন-উচ্চতার অর্থনীতি এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হয়েছে।
রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি লাইসেন্স ও বাণিজ্যিক মহাকাশ উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে সমান আচরণ নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় গবেষণা স্থাপনাগুলো গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের জন্য আরও উন্মুক্ত হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বিদেশি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা
স্থানীয় সরকারের ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছু আঞ্চলিক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে।
লাভজনকতা, কার্যক্ষমতা ও সক্ষমতার ওপর কঠোর মানদণ্ড আরোপ করা হয়েছে।
তবে পূর্বের বিদেশি ঋণের পুনঃঅর্থায়ন এতে বাধাগ্রস্ত হবে না।
পরিসেবা খাত উন্নয়ন নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক
NDRC চেয়ারম্যান ঝেং শানজিয়ে শিল্প অটোমেশন, সফটওয়্যার, রেস্তোরাঁ খাত এবং কনজিউমার সার্ভিস উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
আলোচনায় তিনটি প্রস্তাব উঠে আসে—
প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার আরও গভীর করা,
নতুন নিয়মকানুন কার্যকর করা,
করব্যবস্থা ও সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো উন্নত করা।

বিশ্লেষণ: কেন চীন আবারও বেসরকারি খাতকে সামনে আনছে
দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো অদক্ষতা, লোকসান ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে জর্জরিত ছিল। অবকাঠামো খাতে তারা একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখলেও এখন বেসরকারি খাতকে সামনে এনে উন্নয়নের নতুন গতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে সরকার।
স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য
বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে স্থবির অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা।
বছরের প্রথম ৯ মাসে স্থায়ী সম্পদ বিনিয়োগ ০.৫% কমে যাওয়ার প্রবণতা থামানো।
দীর্ঘমেয়াদি উপলব্ধি
বেসরকারি খাতই—
কর রাজস্বের ৫০ শতাংশ,
জিডিপির ৬০ শতাংশ,
উদ্ভাবনের ৭০ শতাংশ,
শহরাঞ্চলীয় চাকরির ৮০ শতাংশ,
নতুন চাকরির ৯০ শতাংশ যোগান দেয়।
সরকার বুঝেছে, প্রবৃদ্ধির স্থায়ী চালিকা শক্তি বেসরকারি উদ্যোক্তারাই।
অতীতের কঠোরতা: বেসরকারি খাতের জন্য কঠিন সময়
২০২০ সালে অ্যান্ট গ্রুপের আইপিও বাতিল করা হয়।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে লক্ষ্য করে উচ্চমাত্রার তদন্তে ট্রিলিয়ন ডলার বাজারমূল্য হারায়।
২০২১ সালে প্রাইভেট টিউশন শিল্প কঠোর বিধিনিষেধে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।

নীতির পরিবর্তন: আবারও সমর্থন নিশ্চিত
২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং পাঁচ বছর পর প্রযুক্তিখাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
তিনি জানান, বেসরকারি অর্থনীতির উন্নয়নকে সরকার দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে।
২০২৪ সালের মে থেকে কার্যকর হওয়া বেসরকারি খাত উন্নয়ন আইন বাজারে সমান প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করেছে।
১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রস্তুতি নথিতে বেসরকারি খাতকে “বড় ও শক্তিশালী” করার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।
কেন চীনের এখনই বেসরকারি খাতকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন
রিয়েল এস্টেট খাতের দীর্ঘমেয়াদি সংকট,
যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ যুদ্ধে রপ্তানি কমে যাওয়া,
প্রবৃদ্ধির ঐতিহ্যগত উৎস দুর্বল হয়ে পড়া—
এই প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতই এখন চীনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ‘ক্যাশ কাউ’।
#চীন #বেসরকারিখাত #অর্থনীতি #বিনিয়োগ #১৩দফা_পরিকল্পনা #অবকাঠামো #রেলওয়ে #জ্বালানি #পারমাণবিক_প্রকল্প #চীনঅর্থনীতি #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















