তাপদাহ, দূষণ ও রোগের বিরুদ্ধে নতুন উদ্যোগ
ব্রাজিলের বেলেমে চলমান সিওপি৩০ জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্য–ঝুঁকি এবার সামনে চলে এসেছে আলোচনার টেবিলে। একদল বৈশ্বিক দাতাপ্রতিষ্ঠান ঘোষণা করেছে, তাপদাহ, বায়ুদূষণ ও জলবায়ু–সংবেদনশীল রোগ নিয়ে কাজ করতে গড়ে তোলা হচ্ছে ৩০ কোটি ডলারের নতুন তহবিল। গবেষণা ও সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম গরমে প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ছে। তাপমাত্রা আরও বাড়তে থাকলে এই সংখ্যাও দ্রুত বাড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
রকফেলার ফাউন্ডেশন, ওয়েলকাম ট্রাস্টসহ কয়েকটি বড় দাতাপ্রতিষ্ঠান মিলে গড়েছে ক্লাইমেট অ্যান্ড হেলথ ফান্ডার্স কোয়ালিশন। তাদের লক্ষ্য হলো এমন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা, যা নতুন ডেটা ও সমাধান তৈরি করে সরকারগুলোকে নির্দেশ দেবে কোথায় শীতলীকরণ ব্যবস্থা, আগাম সতর্ক বার্তা বা স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একই সময়ে আয়োজক দেশ ব্রাজিল ঘোষণা করেছে বেলেম হেলথ অ্যাকশন প্ল্যান, যার মাধ্যমে স্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি ও অবকাঠামো–বিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলোকে জলবায়ু–স্বাস্থ্য নীতির বিষয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

বর্তমানে জলবায়ু ও স্বাস্থ্য গবেষণায় সরকারি অর্থায়ন আনুমানিক ১০০ থেকে ২০০ কোটি ডলারের মতো। গবেষকরা বলছেন, তাপদাহ, বন–আগুনের ধোঁয়া, অতিবৃষ্টি ও বন্যা–পরবর্তী রোগ বিস্তারের যে মাত্রা দেখা যাচ্ছে, তার তুলনায় এ অর্থ একেবারেই অপ্রতুল। বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত বিশ্লেষণ জানাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হৃদ্রোগ ও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা থেকে শুরু করে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো রোগের ঝুঁকি অনেক অঞ্চলে আবারও বাড়তে শুরু করেছে।
নতুন তহবিল থেকে তাপ সহনশীল শহর গড়ে তোলা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো অভিযোজনে পাইলট প্রকল্পে অর্থ দেওয়া হবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে উজ্জ্বল প্রতিফলকযুক্ত ছাদ, গাছপালাসমৃদ্ধ ছায়াময় হাঁটার পথ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা তাপপ্রবাহের সময় বাড়তি স্টাফসহ হাসপাতাল প্রস্তুত রাখার মতো উদ্যোগগুলো পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার কথা ভাবা হচ্ছে। পাশাপাশি, রিয়েল–টাইম ডেটা সংগ্রহ ও সতর্ক বার্তা পাঠাতে সক্ষম হিট–অ্যালার্ট সিস্টেমও প্রাধান্য পাচ্ছে।

সমতা ও ন্যায্যতার প্রশ্ন এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রচণ্ড গরমে সবচেয়ে বেশি ভোগে শিশু, গর্ভবতী নারী, প্রবীণ এবং খোলা আকাশের নিচে কাজ করা শ্রমিকরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোয়, যেখানে নিরাপদ বাসস্থান বা নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহই সব সময় থাকে না, সেখানে এ ঝুঁকি কয়েকগুণ বেশি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, জলবায়ু–স্বাস্থ্য তহবিল সত্যিকার অর্থে কার্যকর করতে হলে অর্থ ও প্রযুক্তি সরাসরি এসব ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে।
বাংলাদেশ, ভারতসহ উপকূলীয় ও ক্রান্তীয় বহু দেশ ইতোমধ্যে ঘন ঘন তাপপ্রবাহ, ভারী বৃষ্টিপাত ও দীর্ঘায়িত মশা–মৌসুমের চাপে আছে। সিওপি৩০–এ ঘোষিত নতুন অর্থায়ন থেকে যদি কার্যকর গবেষণা ও নীতি–সহায়তা পাওয়া যায়, তবে শহর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে জেলা–উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো তাপ ও বন্যা–ঝুঁকি মাথায় রেখে ডিজাইন করা সহজ হবে। উদাহরণ হিসেবে আনা হচ্ছে—বাজার ও বাস টার্মিনালে ছায়া ও পানির ব্যবস্থা, শ্রমিকদের জন্য তাপ–বিরতির নিয়ম এবং ডেঙ্গু নজরদারিতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম।

তবে জলবায়ু–স্বাস্থ্য তহবিল নিয়ে উৎসাহের মাঝেও কর্মীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দাতাদের অর্থ মোট চিত্রের ছোট একটি অংশ মাত্র। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন দ্রুত না কমাতে পারলে যত তহবিলই গড়া হোক, নতুন নতুন রোগ ও তাপপ্রবাহের ধাক্কা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। সিওপি৩০ দেখাচ্ছে, জলবায়ু আলোচনা এখন আর কেবল ডিগ্রি সেলসিয়াসের হিসাব নয়, হাসপাতালের বেড, প্রাথমিক চিকিৎসা আর মানুষের বাস্তব জীবনের কষ্টের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















