রুশদের ইউরোপ যাত্রা—অতীত থেকে বর্তমান
বাজেট এয়ারলাইনের যুগ বা ইনস্টাগ্রামভিত্তিক পর্যটনের অনেক আগেই রুশরা পশ্চিমে যেতেন মূলত শেখার উদ্দেশ্যে। ১৬৯৭ সালে পিটার দ্য গ্রেট আমস্টারডাম, লন্ডন ও ভিয়েনা সহ নানা শহর ভ্রমণ করেন আধুনিকতার অভিজ্ঞতা নিতে। তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করলেও তাঁর উচ্চতা ও বড় সহচরদলের কারণে তাঁকে সহজেই চেনা যেত।
দেশে বিদ্রোহের খবর পেয়ে তিনি ফিরে আসেন। এরপর ফেরত এসে দাড়িকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ ঘোষণা করে ট্যাক্স আরোপ করেন। তাঁর এ যাত্রা ইউরোপের জন্য শুরু করে দুই দশকব্যাপী গ্রেট নর্দার্ন যুদ্ধের মতো উত্তাল সময়।
ইউরোপে রুশ পর্যটকদের উপস্থিতি এখনো শক্তিশালী
তিন শতাব্দী পরও, এবং ইউক্রেনে পুতিনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার তিন বছর পরও রুশদের ইউরোপ ভ্রমণ থামেনি। গ্র্যান্ড ট্যুরের আগের মতো বড় ভ্রমণ না থাকলেও মিকোনোসের সৈকত, মিলানের শপিং বা কুরশেভেলের স্কি এখনো রুশ পর্যটকদের টানে।
২০২৪ সালে শেঙ্গেন অঞ্চল রুশ নাগরিকদের ৫ লাখের বেশি ভিসা দেয়। এটি ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ৯০ শতাংশ কম। ইউরোপীয়দের একাংশ মনে করেন—ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা চলতে থাকা অবস্থায় রুশ নাগরিকদের ইউরোপে পর্যটন অব্যাহত রাখা নৈতিকভাবে জটিল। এ কারণে ৭ নভেম্বর ইইউ ঘোষণা করে—রুশদের আর বহুবার ভ্রমণযোগ্য ভিসা দেওয়া হবে না, যাতে সংখ্যাটি প্রায় শূন্যে নেমে আসে।
এই সিদ্ধান্তকে কেউ যুক্তিসঙ্গত বলছেন, আবার অনেকেই একে ভুল পদক্ষেপ মনে করছেন—এমনকি পুতিনবিরোধীরাও আপত্তি তুলেছেন।

নিরাপত্তার কারণেই ভিসা কঠোরতা
ইউক্রেন আক্রমণের বাইরে রাশিয়া ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন ‘গ্রে জোন’ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে—বিমানবন্দরে ড্রোন ওড়ানো, বাল্টিক সাগরে কেবল ক্ষতি করা, সাইবার আক্রমণ ইত্যাদি। এসবের সঙ্গে রাশিয়ান নাগরিকদের সরাসরি যুক্ত করা কঠিন হলেও ইউরোপীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ধারণা—প্রত্যেক রুশ ভ্রমণকারীই সম্ভাব্য ঝুঁকির উৎস হতে পারে।
তাই বহুবার ভ্রমণযোগ্য ভিসা বন্ধ করে প্রতিবার ইউরোপে প্রবেশের আগে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া কঠোর করা হয়েছে।
ভিসা নিষেধাজ্ঞার নৈতিক যুক্তি
ইইউ’র বৈদেশিক নীতির প্রধান ও এস্তোনিয়ার কঠোরপন্থী নেতা কায়া কালাস বলেন—যারা যুদ্ধ শুরু করেছে, তারা আবার ইউরোপে অবাধে ঘুরে বেড়াবে—এটি ন্যায়সংগত নয়। পূর্ব ইউরোপের বহু দেশ দীর্ঘদিন ধরে দাবি করছে—ধনী বা মধ্যবিত্ত যেই হোক, যারা ইউরোপে ছুটি কাটাতে পারে, তারা রুশ সরকারের ওপর চাপ কমায় এবং পুতিনশাসনকে পরোক্ষভাবে শক্তিশালী করে।
তবে ব্যতিক্রমও রাখা হয়েছে—যারা ইইউ নাগরিকদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বা স্পষ্টভাবে ভিন্নমতাবলম্বী।
সব রুশ নাগরিককে পুতিনপন্থী ভাবা কি ঠিক?
নিরাপত্তার যুক্তি স্পষ্ট হলেও সব রুশ নাগরিক পুতিনের সমর্থক—এ ধারণা জটিল। অনেক ইউরোপীয় অস্বস্তিতে পড়েন যখন প্যারিসের ক্যাফে বা আল্পসের স্কি-রিসর্টে রুশদের ঘুরতে দেখেন—যারা ফিরে গিয়ে কর দেবেন, আর সেই কর ব্যবহৃত হবে যুদ্ধ অর্থায়নে।

তবু প্রশ্ন উঠে—একনায়কতন্ত্রের দায় কি ১৪ কোটি মানুষের ওপর চাপানো উচিত?
ইউরোপ কিছুদিন আগেও মনে করত—সাধারণ রুশরা পুতিনের প্রতিনিধি নয়; বরং তারা সম্ভাব্য পরিবর্তনকারী। ইউরোপে তাদের ভ্রমণ রাশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি কমাতেও ভূমিকা রাখে।
ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত—ইউরোপে বদলেছে মনোভাব
এখন ইউরোপে একটি নতুন ধারণা শক্ত হচ্ছে—মধ্যবিত্ত রুশ নাগরিকদের উচিত নিজেদের স্বৈরশাসককে ক্ষমতা থেকে সরাতে কিছু করা; না করলে তারা সহযোগীই থেকে যাবেন। কিন্তু একজন সাধারণ নাগরিকের পক্ষে একনায়ককে সরানো কি বাস্তবসম্মত? যাদের সামান্য প্রতিবাদেও কারাবাস হচ্ছে, তাদের কাছে এটি খুবই কঠিন।
অ্যালেক্সেই নাভালনির স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়া এই নিষেধাজ্ঞার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, এই নীতি রাশিয়াকে ইউরোপ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করবে—যা পুতিনের মূল লক্ষ্য।
নিষেধাজ্ঞার অনিচ্ছাকৃত ক্ষতি
সরকারকে লক্ষ্য করে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা শেষ পর্যন্ত সাধারণ রুশদেরই বেশি ক্ষতি করতে পারে। ইউরোপ বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য বড় ধরনের সংঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময়ে রুশ পর্যটকদের স্বাগত জানানো কতটা যুক্তিযুক্ত—এ প্রশ্ন আছে।

রাশিয়ার জনগণ নিজেরাই বহু ক্ষেত্রে নির্যাতিত; কিন্তু ইউরোপে তাদের ভ্রমণ সীমিত হওয়ায় নতুন উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। তবু ইউরোপীয়দের ধারণা—যুদ্ধ চলাকালীন রুশ পর্যটন অব্যাহত থাকলে তা নৈতিক দুর্বলতারই প্রমাণ হবে।
ইউরোপ বলছে—যুদ্ধ শেষে সবাইকে আবার স্বাগত জানানো হবে।
#রাশিয়া # ইউরোপ #ভিসা-নিষেধাজ্ঞা #ইউক্রেন-যুদ্ধ #রাজনৈতিক-প্রতিক্রিয়া
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















