১৯৭৫ সালের ২০ নভেম্বর ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর মাধ্যমে বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী তার দীর্ঘ একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে। এই মৃত্যু স্পেনকে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার নতুন সুযোগ দেয়। অর্ধশতাব্দী পরে দেশটি আজ উন্নত, আধুনিক ও সমৃদ্ধ। তবে সামনে এসেছে নতুন সংকট, যা এই সাফল্যকে দুর্বল করে দিতে পারে।
কারাবানচেল কারাগারের সেই সকাল
১৯৭৫ সালের সেই দিন নিকোলাস সার্থোরিয়াস মাদ্রিদের শ্রমজীবী অঞ্চলের কারাবানচেল কারাগারে বন্দী ছিলেন। কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন আন্ডারগ্রাউন্ড শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের দমনের অংশ হিসেবে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কাঁচবিহীন জানালা, চরম শীত–গরম, ইঁদুর–তেলাপোকার ভিড়—এসবের মধ্যেই বন্দীরা খবর পান যে ফ্রাঙ্কো মারা গেছেন। সার্থোরিয়াস মনে করেন, তখন তাদের মনে হয়েছিল—এখন সবই সম্ভব।
গণতন্ত্রে উত্তরণ
তবে বাস্তবতা ছিল কঠিন। ফ্রাঙ্কো নিজের ক্ষমতার কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখেই মারা যান। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্ষমতা ফিরে যায় রাজতন্ত্রে, আর রাজা হন হুয়ান কার্লোস। প্রথমে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও তিনি দ্রুত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেন। আরও বড় বিষয় হলো—নিজের একনায়ক ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। স্পেন ধীরে ধীরে গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়, কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলে এবং ১৯৮২ সালে ন্যাটো ও ১৯৮৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়।

অর্থনীতি ও সমাজের অগ্রগতি
ফ্রাঙ্কোর শেষ দিকের অর্থনৈতিক সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে স্পেন দ্রুত উন্নত দেশের সারিতে উঠে আসে। তখন শহরে বস্তি ও দারিদ্র্য ছিল সাধারণ চিত্র। গড় আয়ু ছিল ৭৩ বছর, যা আজ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪–তে। মাথাপিছু প্রকৃত আয়ও আড়াই গুণ বেড়েছে।
সমাজেও বড় পরিবর্তন আসে। কঠোর ক্যাথলিক ধর্মীয় অনুশাসন থেকে বেরিয়ে স্পেন হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম উদার সমাজ, আর নারীর অধিকার বিস্তারে ঘটে বড় ধরনের অগ্রগতি।
সহিংসতা ছাড়াই সফল রূপান্তর
স্পেনের গণতন্ত্রে উত্তরণ মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল। ১৯৮১ সালে রাজার হস্তক্ষেপে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়। বাস্ক সশস্ত্র গোষ্ঠী ইটিএ বহু বছর সহিংসতা চালালেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়।
বামপন্থীরা রাজতন্ত্র মেনে নেয়, ডানপন্থীরা স্বায়ত্তশাসনকে গ্রহণ করে। অতীতের অপরাধ ভুলে যাওয়ার জন্য সাধারণ ক্ষমাও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। উত্থান ঘটে র্যাডিকাল বামপন্থী দল পোদেমোসের। অন্যদিকে কাতালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদ ২০১৭ সালের অবৈধ গণভোটের মাধ্যমে চরমে পৌঁছায়। এর প্রতিক্রিয়ায় ডানপন্থী ভক্সের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
রাজনৈতিক টানাপোড়েন
২০২৩ সালের নির্বাচনে দুই বড় দল—সোশ্যালিস্ট ও পিপি—মোট ভোটের সত্তর শতাংশ পায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ ২০১৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘু সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। অস্থির জোটের ওপর নির্ভর করায় ২০২৩ সালের পর থেকে তিনি কোনো বাজেটও পাস করাতে পারেননি।
ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর ৫০ বছর উপলক্ষে তিনি ‘স্বাধীনতার স্পেন’ উদযাপনের ঘোষণা দিলে তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অনেকের মতে, উদযাপনের মূল কেন্দ্র হওয়া উচিত ১৯৭৮ সালের গণতান্ত্রিক সংবিধান।

গণতন্ত্রের বর্তমান সংকট
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো স্পেনও আজ নানা সমস্যার মুখোমুখি। অভিবাসন সংকট বাড়ছে, গ্রামাঞ্চল জনশূন্য হচ্ছে, শহরে বাড়ির অভাব প্রকট, আর জনমত ও রাজনীতির মধ্যে ব্যবধানও গভীর হচ্ছে।
ইউরোব্যারোমিটারের জরিপ বলছে—ইউরোপে সংসদের ওপর আস্থাহীনতার তালিকায় স্পেন প্রায় শীর্ষে।
অর্থনীতির দৃঢ় ভিত্তি
মহামারি–পরবর্তী সময়ে স্পেনের অর্থনীতি ইউরো অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ গতিতে বেড়েছে। ২০০৮ সালের মন্দায় বেকারত্ব ২৬ শতাংশে পৌঁছালেও ২০১৪ সালের পর থেকে প্রবৃদ্ধি আবার স্থিতিশীল হয়। ২০১৪ সাল থেকে চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত। উৎপাদনশীলতা ও বাস্তব আয়—দুটোতেই ধীর কিন্তু স্থায়ী উন্নতি দেখা যাচ্ছে।
পর্যটন, অভিবাসন, ইউ–এর নেক্সট জেনারেশন তহবিল, এবং প্রযুক্তি, বায়োটেক, ফার্মার মতো উচ্চমূল্য খাত এই প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
তরুণদের সংকট ও অভিবাসন
প্রতি বছর ১ লাখ ৪০ হাজার নতুন পরিবার গড়ে উঠলেও বাসা নির্মিত হয় মাত্র ৮০ হাজার। ফলে বাসা পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। জন্মহারও কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.২—যা বিশ্বের অন্যতম নিচু হার। এর ফলে অভিবাসনের ওপর নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। বর্তমানে স্পেনের ১৯ শতাংশ জনসংখ্যাই অভিবাসী।
তবে সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, অধিকাংশ মানুষ মনে করেন অভিবাসন এখন ‘খুব বেশি’। ভক্সের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণগুলোর একটি এটিও।
বিভাজন ও প্রশাসনিক দুর্বলতা
স্পেনের আংশিক ফেডারেল কাঠামো সমন্বয়হীনতার কারণে বিভিন্ন জায়গায় সমস্যা সৃষ্টি করছে। ২০১৭ সালের কাতালোনিয়া সংকট, ভ্যালেন্সিয়ার বন্যা ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা এবং গ্রীষ্মের বন আগুন মোকাবিলায় অদক্ষতা—সবই প্রশাসনিক দুর্বলতার উদাহরণ।
রাজতন্ত্রও বিতর্কে পড়ে। ২০১৪ সালে রাজা হুয়ান কার্লোসের ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফাঁসের পর তিনি পদত্যাগ করেন। তার ছেলে রাজা ফেলিপে মর্যাদা পুনর্গঠনে কাজ করছেন।

দায়বদ্ধতার সংকট
আইনজীবী মিরিয়াম গনসালেসের মতে, দুই প্রধান দলে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। হাজারো রাজনীতিক বিশেষ বিচারিক সুবিধা পান। মন্ত্রীদের স্বজনপ্রীতি রোধে কোনো নীতিমালা নেই।
স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও ক্ষতি করছে।
দুই দলের চরম বৈরিতা
দুই প্রধান দল ক্রমাগত একে অন্যের ক্ষমতার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সোশ্যালিস্টরা মনে করে ভক্সের ওপর নির্ভরশীল পিপি অগ্রহণযোগ্য। পিপির মতে, কাতালোনিয়ান নেতাদের ব্যাপক ক্ষমা দিয়ে সানচেজ ২০২৩ সালে অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় টিকে আছেন।
তবুও সাধারণ মানুষের জীবনমান তুলনামূলকভাবে ভালোই আছে। বহু বিদেশি স্পেনে বসবাসের জন্য দেশটি বেছে নিচ্ছে—যা প্রমাণ করে দেশের সামগ্রিক সফলতা এখনো অব্যাহত।
নিকোলাস সার্থোরিয়াস বলেন—স্পেন এখনো একটি বড় সাফল্যের দেশ। চ্যালেঞ্জ অনেক, কিন্তু সময়ও আছে। রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব হলো—এই সাফল্য যেন হারিয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করা।
#স্পেন #ফ্রাঙ্কো #ইউরোপ #গণতন্ত্র #রাজনীতি #কাতালোনিয়া #অভিবাসন #অর্থনীতি #ইউরোপীয় ইউনিয়ন
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















