অনিশ্চয়তার মাঝে ইতিহাসের পথচলা
আমেরিকার ২৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এমন এক সময়ে এসেছে, যখন রাজনৈতিক সহিংসতা, ভয় ও বিভাজন জাতিকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছে। উদযাপনের বছর হলেও অনেকের মনে দুশ্চিন্তা—এই গুরুত্বপূর্ণ জন্মমুহূর্ত কীভাবে স্মরণ করা হবে, কিংবা আদৌ স্মরণ করা যাবে কি না।
‘নো কিংস’ আন্দোলন: প্রতীকের মাধ্যমে প্রতিবাদ
গত জুনে ভারমন্টের একটি ছোট্ট শহরে বৃষ্টির মধ্যেই “নো কিংস” র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। কারও মাথায় কাগজের মুকুট, কারও গায়ে লাল-কালো প্রজাপতির পোশাক—ইঙ্গিত, আমেরিকায় একমাত্র গ্রহণযোগ্য ‘মনার্ক’ হলো প্রজাপতি। মানুষের হাতে থাকা ব্যঙ্গাত্মক কথাগুলো ইতিহাসের আদর্শকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে—আজও কি বিপ্লবের মূল চেতনা অটুট?
২৫০ বছরের পরিকল্পনা: শুরুতেই টানাপোড়েন
২০২৫ সালের ১৯ এপ্রিল লেক্সিংটন-কনকর্ডের যুদ্ধের পুনর্নির্মাণ প্রদর্শনীর মাধ্যমে উদযাপন শুরু হয়েছে। ২০২৬ সালের ৪ জুলাই প্যারেড, পিকনিক ও আতশবাজি হবে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা পুরো পরিবেশকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক হত্যা, ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন এবং ফেডারেল অভিযানের কারণে শান্তিপূর্ণ উদযাপনের সম্ভাবনা কমে গেছে।
ইতিহাসের ব্যাখ্যা নিয়ে রাষ্ট্রীয় চাপ
বিপ্লবের গল্প কে বলবে—এ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। ২০১৬ সালে গঠিত A250 কমিশন শুরু থেকেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে থমকে আছে। অর্থের ঘাটতি, পরিকল্পনার বিশৃঙ্খলা—সবকিছু মিলিয়ে উদ্যোগ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার ওপর নতুন প্রশাসনের নির্দেশ—ইতিহাস বলতে হবে এমনভাবে, যাতে “মহত্ত্ব, সামরিক বীরত্ব ও জাতীয় গৌরব” প্রধান হয়ে ওঠে। অনেক প্রতিষ্ঠান এসব শর্ত মানতে রাজি নয় এবং অনুদান গ্রহণ পর্যন্ত বাদ দিয়েছে।
মামলা, বিরতি ও সাংস্কৃতিক শঙ্কা
ওরেগন হিউম্যানিটিজ অনুদান বন্ধের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বহু প্রতিষ্ঠান আয়োজন স্থগিত করেছে। জাদুঘরগুলো এমনকি লেবেল লেখাতেও সতর্ক—অনেকে ভাবছে শুধু শিল্পকর্ম দেখাবে, ব্যাখ্যা দেবে না। সমান্তরালে ১৬১৯ প্রকল্পের সমালোচনার প্রভাবও চাপ সৃষ্টি করছে। কেউ কেউ বিপ্লবকে উদযাপনের বদলে ভুল হিসেবে চিত্রিত করতে চাইছে।
১৯৭৬-এর তুলনায় ক্ষুদ্র পরিসর
১৯৭৬ সালের দ্বিশতবার্ষিকীতে আমেরিকা জাঁকজমকপূর্ণ উদযাপন দেখেছিল। এবার সেই মহিমা নেই। মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম মাত্র ৩২টি বস্তু প্রদর্শন করবে—রাজনৈতিক তাপমাত্রা এতটাই বেশি যে বড় উদ্যোগ নিতে সবাইই দ্বিধাগ্রস্ত।
নতুন দৃষ্টিভঙ্গির খোঁজে
নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি সাধারণ নাগরিককে প্রশ্ন করছে—এই বার্ষিকী তাদের কাছে কী অর্থ বহন করে? সেই উত্তর সংরক্ষণ করা হবে ভবিষ্যতের নথি হিসেবে। অন্যদিকে সরকারি তহবিল কমে যাওয়ায় রেডিও, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও শিক্ষামূলক প্রকল্প সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
ইতিহাসের অস্বস্তিকর অংশ মুছে ফেলার আশঙ্কা
ঘোষণাপত্রের ঘর বা প্রেসিডেন্টস হাউসের মতো স্থানে দাসপ্রথা নিয়ে প্রদর্শনী সীমিত করার নির্দেশ এসেছে। বলা হচ্ছে—এসব “অপমানজনক”। ফলে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সত্য আড়াল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। জাদুঘরগুলোকে বলা হয়েছে—যে কোনো প্রদর্শনী যা আমেরিকার অতীতকে “অযথা নিন্দা” করে বলে মনে হবে তা সরিয়ে ফেলতে হবে।
চ্যালেঞ্জের মাঝেও কিছু ইতিবাচক কাজ
হিস্ট্রি কলোরাডোর “মোমেন্টস দ্যাট মেড আস” প্রদর্শনীতে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন দেখানো হচ্ছে। পাশাপাশি কলোরাডোর ১৪ হাজার ফুট উচ্চতার পর্বতগুলোকে কেন্দ্র করে আরোহন অভিযানের পরিকল্পনা হয়েছে। মিউজিয়াম অব দ্য আমেরিকান রেভল্যুশন “দ্য ডিক্লারেশনের জার্নি” প্রদর্শনীতে ঘোষণা-পত্রের ভাবনার বিশ্বভ্রমণ তুলে ধরছে।

দেশজুড়ে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া
পূর্ব উপকূল উদ্বেগে ভুগলেও অন্যান্য রাজ্য তুলনামূলক স্বস্তিতে আছে। কানসাস সিটি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির সঙ্গে এই উদযাপন মিলিয়ে নিচ্ছে। অ্যারিজোনায় ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর, প্রকৃতি-ভিত্তিক অনুষ্ঠান এবং সামরিক হাঁটা–সাইকেল–দৌড় হচ্ছে নিয়মিত। তরুণদের যুক্ত করতে চলছে “ইউথ২৫০” উদ্যোগ।
কেন বার্নস: ইতিহাসের গভীর পাঠ
PBS-এ কেন বার্নসের “দ্য আমেরিকান রেভল্যুশন” ডকুমেন্টারি ১২ ঘণ্টার বিস্তৃত নির্মাণ। দৃশ্য, সংগীত, চিঠির পাঠ, মানচিত্র, প্রাকৃতিক দৃশ্য ও পুনর্নির্মাণ মিলিয়ে এটি বিপ্লবকে গভীর বাস্তবতার সঙ্গে দেখায়। স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল একসঙ্গে গৃহযুদ্ধ, উপনিবেশ যুদ্ধ ও বিশ্বরাজনীতির লড়াই। স্বাধীনতা ও দাসত্ব—এই দ্বন্দ্বও তুলে ধরা হয়েছে স্পষ্টভাবে।
বিপ্লবের শিক্ষা ও বর্তমান প্রশ্ন
ডকুমেন্টারি মনে করিয়ে দেয়—বিপ্লব ছিল নানা জাতি, ভাষা ও পটভূমির মানুষের সম্মিলিত সংগ্রাম। তারা বিশ্বাস করত—মানুষ নিজেই নিজের শাসক। আজকের অস্থির সময়ে সে প্রশ্ন আবার সামনে এসেছে: মানুষ কি এখনও নিজের শাসক? আইন কি এখনও সর্বোচ্চ?
সমসাময়িক বিভাজন
“নো কিংস” আন্দোলন এখন প্রতিরোধের প্রতীক। বিপরীত শিবির এটিকে “আমেরিকা-বিরোধী” বলে আক্রমণ করছে। সামাজিকমাধ্যমে ব্যঙ্গ ছড়াচ্ছে। তবুও ভারমন্টে মানুষ আবারও সমাবেশে সাধারণ বোধ ও সাধারণ ভূমির কথা বলেছে। লেখক মনে করেন—তার হাতে প্ল্যাকার্ড থাকলে টমাস পেইনের কথাই লিখতেন: যে শাসক নিষ্ঠুর, নির্জীব ও মূর্খ—তার প্রতি আনুগত্য দেখানোর চেয়ে ‘বিদ্রোহী’ বলা হওয়া ভালো।
ইতিহাসের গুরুত্ব অক্ষয়
অস্থিরতার মাঝেও সত্য একটাই—ইতিহাসের সৎ পর্যালোচনা অপরিহার্য। দেশের জন্মমুহূর্তকে পুনর্বিবেচনার এই সুযোগ হারালে বিভেদের ক্ষত আরও গভীর হবে। লেখকের জীর্ণ কিন্তু প্রিয় সেই পুরোনো টুপির মতো—যার ওপর লেখা আছে একটাই বাক্য: History Matters. ইতিহাসের গুরুত্ব কখনোই অস্বীকার করা যায় না।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















