০১:১৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

ভারতের গরিব মানুষের জীবনে দাবদাহের নিঃশব্দ বিপর্যয়

 দীর্ঘায়িত গরমে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠী

ভারতে প্রতিবছর একশ’ কোটি মানুষ তাপদাহের মুখোমুখি হন। সবচেয়ে ঝুঁকিতে তাঁরা, যারা রাস্তা, ফুটপাত, খোলা মাঠ বা অস্বাস্থ্যকর কারখানায় দিনভর কাজ করেন। দীর্ঘসময় তীব্র গরমে থাকা শুধু তাৎক্ষণিক অসুস্থতা নয়, ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ক্ষতি এবং আয় হ্রাসের বড় সংকট তৈরি করে—বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে।

আহমেদাবাদের ফুটপাত: রোদ–পিচের মাঝখানে বাঁচার লড়াই

আহমেদাবাদের ৪৫ বছর বয়সী কান্তাবেন কিষেন পারমার প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ফুটপাতে সবজি বিক্রি করেন। তাঁর মাথার উপর জ্বলন্ত রোদ, নিচে উত্তপ্ত পিচ। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও তাঁর কর্মঘণ্টা কমে না। ফলে বছর বছর শরীরে তাপের চাপ বাড়তেই থাকে।

তিন বছর আগে তিনি প্রচণ্ড গরমে অচেতন হয়ে হাসপাতালে যান। ডায়াবেটিস থাকার কারণে ডিহাইড্রেশন তাঁর জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এরপর থেকে মাথা ঘোরা, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন এবং অতিরিক্ত মাসিক রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা নিয়মিত দেখা দেয়। তিনি বলেন, “উপর থেকে গরম, নিচ থেকেও গরম। আমরা গরিব মানুষ কোথায় যাব? বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই।”

ভারতের বৃহত্তর বাস্তবতা: অনানুষ্ঠানিক খাত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ

ভারতের শতকোটি মানুষ প্রতি বছর তাপদাহের ঝুঁকিতে থাকেন, কিন্তু সবচেয়ে বিপর্যস্ত অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা—হকার, নির্মাণশ্রমিক, গৃহকর্মী, পৌরশ্রমিক, কারখানার শ্রমিক। সরকারি নীতিতে সচেতনতার কাজ চলছে—কাজের সময় কমানো, পানীয় গ্রহণ বাড়ানো, ছায়ায় থাকা ও বিরতি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলো স্বল্পমেয়াদি সমাধান। দীর্ঘসময় গরমে থাকলে শরীরে যে স্থায়ী ক্ষতি হয়, সেটাই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে বড় সংকট।

হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যাপক সাচ্চিত বালসারি বলেন, “দীর্ঘমেয়াদি তাপচাপ আসলেই একটি জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা। হিটওয়েভ পার করানো সহজ—কিন্তু মানুষের জীবনের মান নষ্ট হওয়া আটকানো কঠিন।”

Women Toiling in India's Insufferable Heat Face Mounting Toll on Health - The New York Times

রেকর্ড গরম ও ভারতের ধীর প্রতিক্রিয়া

২০২৪ ছিল ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। ২০২৫ সালেও এপ্রিলেই তীব্র তাপদাহ শুরু হয়, অনেক জায়গায় তাপমাত্রা ৪৮–৪৯ ডিগ্রির কাছাকাছি ওঠে। উন্নত দেশগুলো যেমন জাপান—এ ধরনের পরিস্থিতিতে আইন করে শীতলীকরণ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু ভারত এখনও নীতি ও বাস্তবায়নে পিছিয়ে আছে।

তাপজনিত মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আড়ালে রয়ে যায়

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের প্রকৃত তাপ–সম্পর্কিত মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসেবে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। হিটস্ট্রোকের মতো সরাসরি মৃত্যু নথিভুক্ত হলেও ধীরে ধীরে কিডনি বিকল হওয়া, হৃদ্‌রোগ বাড়া বা অঙ্গপ্রতঙ্গ দুর্বল হওয়ার মতো তাপ–চাপজনিত মৃত্যু নথিভুক্ত হয় না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দিলীপ মাভলঙ্কর বলেন, “হিট ডেথ যেন বরফশৈল—যা দেখা যায়, সেটাই পুরো সমস্যার এক-দশমাংশ।”

গবেষকদের মতে, একটি একক জাতীয় ডাটাবেস এবং অভিন্ন মানদণ্ড তৈরি করা জরুরি। শহরের কোন এলাকাগুলো বেশি তাপ ধারণ করে—এমন সূক্ষ্ম তথ্য ছাড়া ঝুঁকির মাত্রা বোঝা অসম্ভব।

নারীদের ওপর দ্বিগুণ চাপ

ভারতে কর্মজীবী নারীর ৯০ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তাঁদের কাজ কমলে আয়ও কমে যায়, যা পরিবারের খাবার থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ বিল পর্যন্ত সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলে। সেলফ–এমপ্লয়েড উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান রীমা নানাভাটি জানান, গ্রীষ্মকালে বহু নারী তাঁদের আয়ের অর্ধেকেরও বেশি হারান। এতে তাঁরা ধার করতে বাধ্য হন এবং অনেক সময় বিদ্যুৎ বিল দিতে না পারায় ফ্যান ব্যবহারও বন্ধ হয়ে যায়।

হংসাবেনের গল্প: আয় কমলে খাবারও কমে যায়

আহমেদাবাদের বর্জ্য সংগ্রাহক হংসাবেন ভেজয় আহির ভোরবেলায় বের হয়ে প্লাস্টিক–কাগজ সংগ্রহ করেন। কিন্তু গরম এত বেড়ে গেছে যে প্রতি মাসে প্রায় এক সপ্তাহ অসুস্থতার কারণে কাজ করতে পারেন না। দৈনিক আয় মাত্র ২০০ রুপি, যা গরমে আরও কমে। তিনি বলেন, “যেদিন আয় করি, সেদিন খাই। না করলে ধার করতে হয়।”

সবজি বিক্রেতা কান্তাবেনও জানান, গ্রীষ্মকালে তাঁর মাসিক আয় ১৫ হাজার থেকে কমে ১০ হাজার রুপিতে নেমে আসে। পিচে বসে থাকলে শরীরই নয়, সবজিগুলোও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।

নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা: পানিশূন্যতা ও সংক্রমণ

অনেক নারী কম পানি পান করেন, যাতে বারবার টয়লেটে যেতে না হয়। আবার অনেক জায়গায় নিরাপদ টয়লেট নেই। এতে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, ডিহাইড্রেশন, মাথা ঘোরা এবং অতিরিক্ত ক্লান্তির মতো সমস্যা বাড়ছে। কান্তাবেন এখন গরম পিচ থেকে বাঁচতে কাঠের স্টুল ব্যবহার করেন এবং যতটা সম্ভব তুলোর পোশাক পরেন।

Women Toiling in India's Insufferable Heat Face Mounting Toll on Health - The New York Times

গরম থেকে ঘরও নিরাপদ নয়: নতুন গবেষণার উদ্বেগজনক তথ্য

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৪ সাল থেকে আহমেদাবাদের ৩০০ নারী শ্রমিকের উপর তাপ–প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছে। তাঁদের ঘরে তাপমাত্রা সেন্সর বসানো হয়েছে এবং ফিটবিটের মাধ্যমে হৃদস্পন্দন, ঘুম এবং শরীরের ক্লান্তি মাপা হচ্ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত ঘরের ভেতর বাইরের তুলনায় বেশি গরম থাকে। ফলে দিনভর গরমে কাজের পরে ঘরেও স্বস্তি মেলে না, এবং রাতভর ঘুম না হওয়ায় শারীরিক চাপ আরও বাড়ে।

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গবেষক লুসি সির্স দেখেছেন—অনেক গার্মেন্টস কারখানায় বায়ু চলাচল খারাপ, মেশিনের তাপ এবং ঘনবসতি মিলিয়ে ভেতরের অবস্থাও বাইরে মতোই বিপজ্জনক।

গ্রামাঞ্চলে তাপদাহের লুকানো সংকট

বিহারের মতো অঞ্চলে গরমে মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। ললিতা দেবী জানান, গরমের সময় অজ্ঞান হওয়া, মাথা ঘোরা এবং ক্লান্তি এত বেড়েছে যে মাঠে যাওয়া ভয় ধরিয়ে দেয়। সেখানে ভূগর্ভস্থ পানিও গরম হয়ে যায়।

অন্যদিকে, পুরুষেরা শ্রমের জন্য অন্য এলাকায় চলে গেলে নারীদের একাই কৃষিকাজ, রান্না এবং পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে হয়। ২৮ বছর বয়সী মীনা কুমারী বলেন, রাতে ফ্যান যেন শুধু গরম বাতাসই ঘুরিয়ে দেয়।

সচেতনতার অভাব থেকে ধীরে ধীরে শেখা

গ্রামীণ উন্নয়ন ট্রাস্টের কর্মী মোহাম্মদ সদুল্লাহ বলেন, অনেক কৃষিশ্রমিক জানতেনই না যে ডিহাইড্রেশনই তাঁদের মাথা ঘোরা ও দুর্বলতার মূল কারণ। পরে তাঁদের শেখানো হয়েছে নিয়মিত পানি ও ঘরে তৈরি ইলেকট্রোলাইট পান করতে—পানি, চিনি, লেবু, লবণ এবং মুড়ির মিশ্রণ।

সদুল্লাহ বলেন, “আবহাওয়া বুঝবে না যে আপনাকে পানি খেতে হবে। আপনাকেই শিখতে হবে।”

তাপদাহ এখন ভারতের নীরব মানবিক সংকট

দীর্ঘমেয়াদি তাপচাপ এখন আর শুধু একটি মৌসুমি ঘটনা নয়। এটি ভারতের গরিব, শ্রমজীবী ও নারীদের জন্য নীরব কিন্তু গভীর মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে। শরীরের ওপর দীর্ঘস্থায়ী চাপ, আয়ের ক্ষতি, পরিবারে খাবার কমে যাওয়া, ঘর ও কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতা—সব মিলিয়ে দাবদাহ এখন দেশের সবচেয়ে উপেক্ষিত জনস্বাস্থ্য সংকট।

# IndiaHeatwave #PoorWorkers #WomenImpact #ClimateCrisis

জনপ্রিয় সংবাদ

ভারতের গরিব মানুষের জীবনে দাবদাহের নিঃশব্দ বিপর্যয়

১১:০২:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫

 দীর্ঘায়িত গরমে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠী

ভারতে প্রতিবছর একশ’ কোটি মানুষ তাপদাহের মুখোমুখি হন। সবচেয়ে ঝুঁকিতে তাঁরা, যারা রাস্তা, ফুটপাত, খোলা মাঠ বা অস্বাস্থ্যকর কারখানায় দিনভর কাজ করেন। দীর্ঘসময় তীব্র গরমে থাকা শুধু তাৎক্ষণিক অসুস্থতা নয়, ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ক্ষতি এবং আয় হ্রাসের বড় সংকট তৈরি করে—বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে।

আহমেদাবাদের ফুটপাত: রোদ–পিচের মাঝখানে বাঁচার লড়াই

আহমেদাবাদের ৪৫ বছর বয়সী কান্তাবেন কিষেন পারমার প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ফুটপাতে সবজি বিক্রি করেন। তাঁর মাথার উপর জ্বলন্ত রোদ, নিচে উত্তপ্ত পিচ। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও তাঁর কর্মঘণ্টা কমে না। ফলে বছর বছর শরীরে তাপের চাপ বাড়তেই থাকে।

তিন বছর আগে তিনি প্রচণ্ড গরমে অচেতন হয়ে হাসপাতালে যান। ডায়াবেটিস থাকার কারণে ডিহাইড্রেশন তাঁর জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এরপর থেকে মাথা ঘোরা, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন এবং অতিরিক্ত মাসিক রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা নিয়মিত দেখা দেয়। তিনি বলেন, “উপর থেকে গরম, নিচ থেকেও গরম। আমরা গরিব মানুষ কোথায় যাব? বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই।”

ভারতের বৃহত্তর বাস্তবতা: অনানুষ্ঠানিক খাত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ

ভারতের শতকোটি মানুষ প্রতি বছর তাপদাহের ঝুঁকিতে থাকেন, কিন্তু সবচেয়ে বিপর্যস্ত অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা—হকার, নির্মাণশ্রমিক, গৃহকর্মী, পৌরশ্রমিক, কারখানার শ্রমিক। সরকারি নীতিতে সচেতনতার কাজ চলছে—কাজের সময় কমানো, পানীয় গ্রহণ বাড়ানো, ছায়ায় থাকা ও বিরতি নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলো স্বল্পমেয়াদি সমাধান। দীর্ঘসময় গরমে থাকলে শরীরে যে স্থায়ী ক্ষতি হয়, সেটাই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে বড় সংকট।

হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যাপক সাচ্চিত বালসারি বলেন, “দীর্ঘমেয়াদি তাপচাপ আসলেই একটি জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা। হিটওয়েভ পার করানো সহজ—কিন্তু মানুষের জীবনের মান নষ্ট হওয়া আটকানো কঠিন।”

Women Toiling in India's Insufferable Heat Face Mounting Toll on Health - The New York Times

রেকর্ড গরম ও ভারতের ধীর প্রতিক্রিয়া

২০২৪ ছিল ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। ২০২৫ সালেও এপ্রিলেই তীব্র তাপদাহ শুরু হয়, অনেক জায়গায় তাপমাত্রা ৪৮–৪৯ ডিগ্রির কাছাকাছি ওঠে। উন্নত দেশগুলো যেমন জাপান—এ ধরনের পরিস্থিতিতে আইন করে শীতলীকরণ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু ভারত এখনও নীতি ও বাস্তবায়নে পিছিয়ে আছে।

তাপজনিত মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আড়ালে রয়ে যায়

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের প্রকৃত তাপ–সম্পর্কিত মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসেবে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। হিটস্ট্রোকের মতো সরাসরি মৃত্যু নথিভুক্ত হলেও ধীরে ধীরে কিডনি বিকল হওয়া, হৃদ্‌রোগ বাড়া বা অঙ্গপ্রতঙ্গ দুর্বল হওয়ার মতো তাপ–চাপজনিত মৃত্যু নথিভুক্ত হয় না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দিলীপ মাভলঙ্কর বলেন, “হিট ডেথ যেন বরফশৈল—যা দেখা যায়, সেটাই পুরো সমস্যার এক-দশমাংশ।”

গবেষকদের মতে, একটি একক জাতীয় ডাটাবেস এবং অভিন্ন মানদণ্ড তৈরি করা জরুরি। শহরের কোন এলাকাগুলো বেশি তাপ ধারণ করে—এমন সূক্ষ্ম তথ্য ছাড়া ঝুঁকির মাত্রা বোঝা অসম্ভব।

নারীদের ওপর দ্বিগুণ চাপ

ভারতে কর্মজীবী নারীর ৯০ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তাঁদের কাজ কমলে আয়ও কমে যায়, যা পরিবারের খাবার থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ বিল পর্যন্ত সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলে। সেলফ–এমপ্লয়েড উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান রীমা নানাভাটি জানান, গ্রীষ্মকালে বহু নারী তাঁদের আয়ের অর্ধেকেরও বেশি হারান। এতে তাঁরা ধার করতে বাধ্য হন এবং অনেক সময় বিদ্যুৎ বিল দিতে না পারায় ফ্যান ব্যবহারও বন্ধ হয়ে যায়।

হংসাবেনের গল্প: আয় কমলে খাবারও কমে যায়

আহমেদাবাদের বর্জ্য সংগ্রাহক হংসাবেন ভেজয় আহির ভোরবেলায় বের হয়ে প্লাস্টিক–কাগজ সংগ্রহ করেন। কিন্তু গরম এত বেড়ে গেছে যে প্রতি মাসে প্রায় এক সপ্তাহ অসুস্থতার কারণে কাজ করতে পারেন না। দৈনিক আয় মাত্র ২০০ রুপি, যা গরমে আরও কমে। তিনি বলেন, “যেদিন আয় করি, সেদিন খাই। না করলে ধার করতে হয়।”

সবজি বিক্রেতা কান্তাবেনও জানান, গ্রীষ্মকালে তাঁর মাসিক আয় ১৫ হাজার থেকে কমে ১০ হাজার রুপিতে নেমে আসে। পিচে বসে থাকলে শরীরই নয়, সবজিগুলোও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।

নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা: পানিশূন্যতা ও সংক্রমণ

অনেক নারী কম পানি পান করেন, যাতে বারবার টয়লেটে যেতে না হয়। আবার অনেক জায়গায় নিরাপদ টয়লেট নেই। এতে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, ডিহাইড্রেশন, মাথা ঘোরা এবং অতিরিক্ত ক্লান্তির মতো সমস্যা বাড়ছে। কান্তাবেন এখন গরম পিচ থেকে বাঁচতে কাঠের স্টুল ব্যবহার করেন এবং যতটা সম্ভব তুলোর পোশাক পরেন।

Women Toiling in India's Insufferable Heat Face Mounting Toll on Health - The New York Times

গরম থেকে ঘরও নিরাপদ নয়: নতুন গবেষণার উদ্বেগজনক তথ্য

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৪ সাল থেকে আহমেদাবাদের ৩০০ নারী শ্রমিকের উপর তাপ–প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছে। তাঁদের ঘরে তাপমাত্রা সেন্সর বসানো হয়েছে এবং ফিটবিটের মাধ্যমে হৃদস্পন্দন, ঘুম এবং শরীরের ক্লান্তি মাপা হচ্ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত ঘরের ভেতর বাইরের তুলনায় বেশি গরম থাকে। ফলে দিনভর গরমে কাজের পরে ঘরেও স্বস্তি মেলে না, এবং রাতভর ঘুম না হওয়ায় শারীরিক চাপ আরও বাড়ে।

নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গবেষক লুসি সির্স দেখেছেন—অনেক গার্মেন্টস কারখানায় বায়ু চলাচল খারাপ, মেশিনের তাপ এবং ঘনবসতি মিলিয়ে ভেতরের অবস্থাও বাইরে মতোই বিপজ্জনক।

গ্রামাঞ্চলে তাপদাহের লুকানো সংকট

বিহারের মতো অঞ্চলে গরমে মানুষের জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে। ললিতা দেবী জানান, গরমের সময় অজ্ঞান হওয়া, মাথা ঘোরা এবং ক্লান্তি এত বেড়েছে যে মাঠে যাওয়া ভয় ধরিয়ে দেয়। সেখানে ভূগর্ভস্থ পানিও গরম হয়ে যায়।

অন্যদিকে, পুরুষেরা শ্রমের জন্য অন্য এলাকায় চলে গেলে নারীদের একাই কৃষিকাজ, রান্না এবং পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে হয়। ২৮ বছর বয়সী মীনা কুমারী বলেন, রাতে ফ্যান যেন শুধু গরম বাতাসই ঘুরিয়ে দেয়।

সচেতনতার অভাব থেকে ধীরে ধীরে শেখা

গ্রামীণ উন্নয়ন ট্রাস্টের কর্মী মোহাম্মদ সদুল্লাহ বলেন, অনেক কৃষিশ্রমিক জানতেনই না যে ডিহাইড্রেশনই তাঁদের মাথা ঘোরা ও দুর্বলতার মূল কারণ। পরে তাঁদের শেখানো হয়েছে নিয়মিত পানি ও ঘরে তৈরি ইলেকট্রোলাইট পান করতে—পানি, চিনি, লেবু, লবণ এবং মুড়ির মিশ্রণ।

সদুল্লাহ বলেন, “আবহাওয়া বুঝবে না যে আপনাকে পানি খেতে হবে। আপনাকেই শিখতে হবে।”

তাপদাহ এখন ভারতের নীরব মানবিক সংকট

দীর্ঘমেয়াদি তাপচাপ এখন আর শুধু একটি মৌসুমি ঘটনা নয়। এটি ভারতের গরিব, শ্রমজীবী ও নারীদের জন্য নীরব কিন্তু গভীর মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে। শরীরের ওপর দীর্ঘস্থায়ী চাপ, আয়ের ক্ষতি, পরিবারে খাবার কমে যাওয়া, ঘর ও কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতা—সব মিলিয়ে দাবদাহ এখন দেশের সবচেয়ে উপেক্ষিত জনস্বাস্থ্য সংকট।

# IndiaHeatwave #PoorWorkers #WomenImpact #ClimateCrisis