চট্টগ্রাম বন্দরের পাঁচটি প্রধান টার্মিনাল একের পর এক বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি ও গোপন চুক্তি, কম ট্যারিফ–আয় এবং শ্রমিক সংগঠনের তীব্র প্রতিবাদ—সব মিলিয়ে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বন্দর এখন বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ–সংকটে পড়েছে।
প্রস্তাবনা
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের প্রধান বাণিজ্যিক প্রবেশদ্বার। সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো দেখায়, বন্দর সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল দ্রুতগতিতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে হস্তান্তর হচ্ছে। এতে জাতীয় স্বার্থ, আয় বণ্টন, ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রমবাজার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে পাঁচটি প্রধান টার্মিনাল
চট্টগ্রাম বন্দরের সাতটি প্রধান টার্মিনালের মধ্যে পাঁচটির নিয়ন্ত্রণ বিদেশি অপারেটরের কাছে গেছে বা যাচ্ছে।
বর্তমানে বন্দর কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করছে শুধু জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি) এবং চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)।
ইতিমধ্যে সই হওয়া চুক্তিগুলো
১৭ নভেম্বর লালদিয়া চর কনটেইনার টার্মিনাল দীর্ঘমেয়াদে দেওয়া হয়েছে ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালসকে।
একই দিনে পানগাঁও নৌ টার্মিনালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মেডলগ এসএ–কে।
এর আগে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব গেছে নৌবাহিনী–নিয়ন্ত্রিত চিটাগাং ড্রাইডক লিমিটেডের কাছে—যাদের হাতে বন্দরের মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রায় ৪৪ শতাংশ।
বে টার্মিনালেও বিদেশিদের আধিপত্য
বন্দরের সবচেয়ে বড় প্রকল্প বে টার্মিনালের দুটি অংশ পরিচালনা করবে ডিপি ওয়ার্ল্ড (আবুধাবি) এবং পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল (সিঙ্গাপুর)।
পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিটিসি) ইতোমধ্যে পরিচালনা করছে সৌদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি)।

লালদিয়া–পানগাঁও চুক্তিকে ঘিরে গোপনীয়তা–বিতর্ক
লালদিয়ার চুক্তি ৪৮ বছরের, যার মধ্যে ১৫ বছর গ্রেস পিরিয়ড।
চুক্তির আর্থিক শর্ত—ট্যারিফ, মাশুল বা কর—সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছে।
পানগাঁও টার্মিনালও বিদেশি অপারেটরের হাতে গেছে ২২ বছরের জন্য।
পিটিসির চুক্তি নিয়ে নতুন অসন্তোষ
বন্দর ব্যবহারকারীদের অভিযোগ—
চট্টগ্রাম বন্দর যেখানে প্রতি টিইইউ থেকে ৮০–৯০ ডলার আয় করে,
পিটিসিতে আরএসজিটি দেবে মাত্র ১৮ ডলার।
প্রথম আড়াই লাখ টিইইউতে বন্দর পাবে শুধু এই ১৮ ডলার, অতিরিক্ত টিইইউতে পাবে নির্ধারিত ট্যারিফের মাত্র অর্ধেক।
উদ্বৃত্ত আয়েও বন্দর পাবে মাত্র ৩০ শতাংশ।
শ্রমিক সংগঠন ও ব্যবসায়ীদের তীব্র প্রতিবাদ
চট্টগ্রাম শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) বলেছে—
দ্রুতগতির এই ইজারা প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ ও জনবিরোধী।
২২ নভেম্বর হরতাল, সড়ক অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
বাম জোট ঘোষণা করেছে—
২৩ নভেম্বর সারাদেশে বিক্ষোভ, গণসংযোগ, পদযাত্রা।
দাবি না মানলে ‘যমুনা ঘেরাও’সহ আরও কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা।
বন্দরের নিয়ম ভেঙে দ্রুত চুক্তির অভিযোগ
ইজারা–প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে ৬২ দিনের সময় লাগার নিয়ম থাকলেও
মোটে ১৩ দিনের মধ্যেই দুটি বড় টার্মিনালের চুক্তি সেরে ফেলা হয়েছে—৪ থেকে ১৭ নভেম্বরের মধ্যে।

এনসিটি–সিসিটি রক্ষায় মশাল মিছিল
চট্টগ্রামে বন্দর রক্ষা পরিষদের উদ্যোগে মশাল মিছিল হয়।
শ্রমিকদের স্লোগান—
“আমার বন্দর আমার মা, বিদেশিদের দেব না”,
“লড়াই করে বাঁচতে চাই”,
“ডিপি ওয়ার্ল্ড গো ব্যাক”।
তাদের দাবি—
এনসিটি বিদেশি হাতে গেলে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাবে।
বে টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর গ্রহণযোগ্য হলেও লাভজনক এনসিটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়া চলবে না।
৪০ ঘণ্টার আলটিমেটাম
শ্রমিক সংগঠনগুলো বলেছে—
৪০ ঘণ্টার মধ্যে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে
২০ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
সরকার ও বিশেষজ্ঞদের অবস্থান
বন্দরের সচিব বলেছেন—
এপিএম টার্মিনালস নিজস্ব অর্থায়নে লালদিয়ায় বিশ্বমানের টার্মিনাল নির্মাণ করবে; বাণিজ্যিক ও সামাজিক শর্ত মানলে চুক্তির মেয়াদ বাড়তেও পারে।
পরিবহন উপদেষ্টা বলেছেন—
আন্তর্জাতিকমান অর্জনে বিদেশি ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন,
তবে জাতীয় স্বার্থই থাকবে অগ্রাধিকার।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মত—
অতিরিক্ত বিদেশি নিয়ন্ত্রণ ভবিষ্যতে ফি বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করবে এবং বন্দর তার ক্ষমতা হারাতে পারে।

জাতীয় স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ অর্থনীতির প্রশ্ন
কৌশলগত এই বন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একটির পর একটি টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে গেলে দেশের বাণিজ্য, শ্রমবাজার ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে—এমন শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞ, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা।
#tags চট্টগ্রাম_বন্দর বিদেশি_ইজারা বন্দর_বিতর্ক লালদিয়া_টার্মিনাল এনসিটি শ্রমিক_আন্দোলন বন্দর_নীতি সরকারী_চুক্তি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















