এনার্জি নিরাপত্তা বনাম নিরাপত্তা ঝুঁকি
জ্বালানি আমদানির ব্যয় আর জলবায়ু প্রতিশ্রুতি—এই দুই চাপের মাঝখানে জাপান আবারও বড় আকারে পারমাণবিক বিদ্যুৎ ফিরিয়ে আনার পথে বড় পদক্ষেপ নিল। নিগাতা প্রিফেকচারের গভর্নর কাশিওয়াজাকি–কারিওয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্তে সম্মতি দিয়েছেন, যা স্থানীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার শেষ বড় বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ প্ল্যান্টের ৬ ও ৭ নম্বর ইউনিট মিলিয়ে ২,৭০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা পুরো কেন্দ্রটির সক্ষমতার উল্লেখযোগ্য অংশ। আগামী ডিসেম্বরের শুরুতে প্রিফেকচার পরিষদে আস্থাভোট হওয়ার কথা, তবে গভর্নরের ঘোষণাই ইতিমধ্যে প্রকল্পটিকে নতুন গতি দিয়েছে।
ফসিল ফুয়েল নির্ভরতা কমানোর কৌশল
২০১১ সালের ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে সব রিঅ্যাক্টর বন্ধ রেখে জাপান শক্তি সরবরাহের বড় অংশই কয়লা ও এলএনজি আমদানিনির্ভর করে তোলে। এর ফলে বিশ্ববাজারে দামের ওঠানামা সরাসরি ঘরে বসে ভোক্তা ও শিল্পখাতকে আঘাত করেছে। টোকিও এখন যুক্তি দিচ্ছে—নতুন নিরাপত্তা নিয়মের আওতায় পরীক্ষিত পারমাণবিক প্ল্যান্টগুলো চালু করলে জ্বালানি আমদানি কমবে, কার্বন নিঃসরণও কমবে, আর তথ্যপ্রযুক্তি ও সেমিকন্ডাক্টর শিল্প বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় স্থিতিশীল বিদ্যুৎ পাওয়া সহজ হবে। কাশিওয়াজাকি–কারিওয়া আংশিক চালু হলে একাই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস আমদানির চাহিদা কমাতে পারে বলেই ধারণা।
স্থানীয় সন্দেহ ও ক্ষোভ এখনো কাটেনি
চালু হওয়ার আগে দীর্ঘদিন ধরে নিরাপত্তা উন্নয়ন আর নথি ব্যবস্থাপনায় ভুল নিয়ে এ প্ল্যান্টকে ঘিরে নানা সমালোচনা হয়েছে। কাছাকাছি বসবাসকারী অনেক বাসিন্দা এখনো অপারেটর কোম্পানিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না; তাদের প্রশ্ন—যদি আবার কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তা কি দ্রুত ও স্বচ্ছভাবে জানানো হবে? স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জরুরি সরে যাওয়ার পরিকল্পনা, চিকিৎসা সহায়তা এবং ক্ষতিপূরণ নীতির বিস্তারিত জানতে চাইছেন। এমন প্রেক্ষাপটে পরিবেশবাদী গোষ্ঠীগুলো বলছে, পুনরায় পারমাণবিক শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা আসলে নতুন প্রজন্মের জন্য আরেক সেট ঝুঁকি তৈরি করা।
সমর্থকদের যুক্তি ও বাস্তবতার টানাপোড়েন
অন্যদিকে সমর্থকদের দাবি, ভূগোল ও সম্পদগত সীমাবদ্ধতার কারণে জাপানের জন্য খুব দ্রুত শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাওয়া বাস্তবসম্মত নয়। বাতাস ও সৌরবিদ্যুৎ বাড়লেও স্টোরেজ ও গ্রিড অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা থাকায় বেস–লোড বা ভিত্তিমূল বিদ্যুৎ এখনো মূলত কয়লা ও গ্যাসের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মতে, এত বড় একটি প্ল্যান্টকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বসিয়ে রাখা অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক, যখন দেশটির বিদ্যুৎ চাহিদা আবারও বাড়ার পথে। কঠোর নিরাপত্তা মানদণ্ড পেরিয়ে ইতোমধ্যে ১৪টি রিঅ্যাক্টর চালু হওয়া এবং ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা তৈরি হওয়াকেও তারা ইতিবাচক নজির হিসেবে তুলে ধরছেন।
বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক শক্তি নিয়ে নতুন বার্তা
জাপানের এ সিদ্ধান্তের প্রভাব দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারেও পড়তে পারে। কাশিওয়াজাকি–কারিওয়া পুরোপুরি চালু হলে এলএনজির চাহিদা কিছুটা হলেও কমবে, যা অন্য আমদানিকারক দেশগুলোর জন্য সরবরাহ ও দামের হিসাব পাল্টে দিতে পারে। একই সঙ্গে, পুনরায় কোনো নিরাপত্তা ত্রুটি বা জনঅসন্তোষ দেখা দিলে তা শুধু জাপানেই নয়, অন্য দেশেও পরিকল্পিত পারমাণবিক প্রকল্পের রাজনৈতিক গতি মন্থর করে দিতে পারে। ফলে এ সিদ্ধান্ত এখন একদিকে শক্তি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে আস্থা পুনর্গঠনের কঠিন পরীক্ষায় জাপানের নতুন অধ্যায় খুলে দিচ্ছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















