ইউক্রেনের মানচিত্র নতুন করে আঁকার প্রস্তাব
ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে কূটনৈতিক টানাপোড়েন নতুন মোড় নিয়েছে মার্কিন সমর্থিত ২৮ দফার এক শান্তি প্রস্তাবের কারণে। ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ মহলের সঙ্গে যুক্ত এই খসড়া পরিকল্পনাকে ঘিরে এখন কিয়েভ, মস্কো ও ইউরোপের বড় রাজধানীগুলোতে তীব্র আলোচনা চলছে। প্রস্তাবে মূলত রাশিয়ার হাতে থাকা যুদ্ধের ময়দানের অর্জনগুলোকে স্থায়ী স্বীকৃতি দেওয়ার ইঙ্গিত থাকলেও উভয় পক্ষের কাছ থেকেই কিছু কষ্টকর ছাড় চাওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ইউক্রেন এই পরিকল্পনা খতিয়ে দেখবে, তবে তিনি পরিষ্কার করেছেন যে কোনো সমাধানই তার দেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব বিসর্জনের বিনিময়ে হতে পারে না।
খসড়ার সবচেয়ে বিতর্কিত অংশটি জড়িয়ে আছে ভৌগোলিক মানচিত্র পুনরায় আঁকার ধারণায়। প্রস্তাব অনুযায়ী, ইউক্রেনকে দোনেস্ক অঞ্চলের অবশিষ্ট অংশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিতে হবে; এর মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোর্স্কের মতো দুর্গ শহর, যেখানে এখনো ইউক্রেনীয় বাহিনী টিকে আছে। একই সঙ্গে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল এবং ২০২২ সালের পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসনের পর চারটি অঞ্চলে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণকে স্থায়ী বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ইউক্রেন কার্যত রাশিয়ার বলে চিহ্নিত হবে। বিনিময়ে রাশিয়াকে কিছু সীমিত এলাকা থেকে সেনা পিছিয়ে নিতে এবং নতুন সীমারেখায় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মেনে নিতে বলা হয়েছে। ইউক্রেনের অনেকে এটিকে দীর্ঘদিনের প্রতিরোধের পর পুরো অঞ্চল হাল ছেড়ে দেওয়ার সমান মনে করছেন।

নিরাপত্তা শর্ত ও ইউরোপের দ্বিধা
নিরাপত্তা কাঠামো নিয়েও প্রস্তাবে বেশ কিছু কঠোর শর্ত রাখা হয়েছে। খসড়া অনুযায়ী, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ ন্যাটো সদস্যপদ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে এবং সেনাবাহিনীর আকার, অস্ত্রের ধরন ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের উপর বিভিন্ন সীমা আরোপ করা হবে। সমর্থকদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা গ্যারান্টি থাকলে এই সীমাবদ্ধতা রাশিয়ার হুমকির ধারণা কমাতে পারে এবং পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি করবে। সমালোচকদের তর্ক, একটি নিরস্ত্র ও আংশিকভাবে নিরপেক্ষ ইউক্রেন বাস্তবে আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে; ভবিষ্যতে শক্তির ভারসাম্য পাল্টালে মস্কো আবারও চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। অতীতের অঙ্গীকার ভঙ্গের উদাহরণ টেনে তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কাগুজে প্রতিশ্রুতি ইউক্রেনকে এর আগে রক্ষা করতে পারেনি।
ইউরোপীয় দেশগুলোর ভেতরে অবস্থান একরকম নয়। যুদ্ধের প্রভাব, জ্বালানি সংকট ও বাজেটের চাপ নিয়ে উদ্বিগ্ন কিছু সরকার মনে করে, অন্তত আলোচনার দরজা খুলে দেওয়া দরকার, যাতে বোঝা যায় ক্রেমলিন সত্যিই কোনও সমঝোতার পথে হাঁটতে চায় কি না। বিপরীতে, ন্যাটোর পূর্ব প্রান্তের কয়েকটি রাষ্ট্রের মতে, এই ধরনের প্রস্তাবে সম্মতি দিলে সংকেত যাবে যে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক আগ্রাসনও শেষ পর্যন্ত পুরস্কৃত হতে পারে। তারা মনে করিয়ে দিচ্ছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ইউক্রেনেরই, এবং জেলেনস্কির ওপর চাপ সৃষ্টি করে ‘অজনপ্রিয় শান্তি’ চাপিয়ে দিলে তা ইউরোপের নিরাপত্তাকেও নাড়িয়ে দিতে পারে। জনমতও অস্থির; ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতি এখনো শক্তিশালী, কিন্তু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় ক্লান্তি বাড়ছে।

কিয়েভের জন্য সমীকরণ আরও কঠিন। একদিকে পশ্চিমা সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হলে তাদের কৌশলগত বিচারের প্রতি আস্থা ধরে রাখতে হবে; অন্যদিকে সামরিক ও বেসামরিক বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্যেও জনগণকে বোঝাতে হবে কেন এত ত্যাগ স্বীকার করা হচ্ছে। জেলেনস্কি সতর্ক করেছেন, যদি শুধু সাময়িক স্বস্তির বিনিময়ে স্থায়ীভাবে ভূমি ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে জাতীয় ঐক্য ভেঙে পড়তে পারে এবং ভবিষ্যতে প্রতিরোধের ইচ্ছাও ক্ষয়ে যাবে। তাই তার উপদেষ্টারা একাধিক পথ ধরে এগোচ্ছেন — একদিকে মার্কিন পরিকল্পনার বিতর্কিত অংশগুলো বদলানোর চেষ্টা, অন্যদিকে রাশিয়ার পূর্ণ প্রত্যাহার দাবি করে নিজেদের দশ দফা শান্তি রূপরেখা এগিয়ে রাখা, আর একই সঙ্গে শীতকালীন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই আলোচনার ফল শুধু ইউক্রেনের ভবিষ্যৎই নয়; যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় শক্তির ভারসাম্য কীভাবে গঠিত হবে, তাও অনেকটা নির্ভর করবে এখানে গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর। যদি বড় শক্তিগুলো এক দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে অগ্রাহ্য করে, বাস্তবে দখলকৃত ভূখণ্ডকে মেনে নিতে রাজি হয়, তাহলে তা বহু সীমান্ত বিরোধে নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করবে; আর যদি পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যাত হয়, তাহলে দীর্ঘায়িত যুদ্ধের চাপও বহুগুণ বাড়তে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















